সব
শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের শেষ প্রহরে একদল বিপদগামী বিশ্বাস ঘাতক সেনা সদস্য স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। সারাদেশে নেমে আসে শোকের ছায়া। সৃষ্টি হয় এক কলঙ্কের অধ্যায়। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের প্রতি ঘৃনা।
এসময় বাংলাদেশ তথা দেশের মানুষের প্রতি বিরূপ মন্তব্য দৃশ্যমান হয় বিভিন্ন দেশের গুনিজনদের মূখে। যা তাৎকালিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানীর নেতা উইলি ব্রানডিট বলেছিলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোন জঘন্য কাজ করতে পারে।
ভারত বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ শ্রী চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছিলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোন অস্তিত্ব নেই।
একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকান্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরে সারাদেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সামনে এমন কেউ ছিলেন না যারা তখন জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সেই অন্ধকারময় আশার আলোহীন দুর্দিনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম সীমান্তে গড়ে তুলেছিলেন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যুদ্ধ।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সারাদেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টু শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন এক দল যোদ্ধা অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে তারা কাঁপিয়ে তোলে সীমান্তবর্তী জনপদ।
একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের অনেকে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে পঁচাত্তরে দেশি বাহিনীর বুলেটের টার্গেটে পরিণত হন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত চলমান ঐ প্রতিরোধ-সংগ্রামে শাহাদত বরণ করেন শতশত বীর যোদ্ধা। স্বৈরশাসকরা এ প্রতিরোধের কারণে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপরে নির্যাতন-নিপিরন ও জেল-জুলুম নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ১৫ তারিখ ভোরে আমি বাসাতে ছিলাম। তখন জানতে পারি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা। তখন আমি তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ কয়েক জন নেতার সঙ্গে কথা বলি।
তাদের বলি, এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তখন এ প্রতিরোধের কথা জানিয়ে লিফলেট প্রকাশ করা হয়। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা এবং পরে ভারতে গিয়ে ২০০ কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত এলাকা জুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। তখন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা প্রতি মাসে চিঠি দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন।
সেই সময় যদি আমরা এ প্রতিরোধ গড়ে না তুলতাম তাহলে জিয়াউর রহমান দেশে আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্বই রাখত না। আমাদের প্রতিরোধের মুখে তারা অন্য নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারেনি।
সর্বোপরি এ প্রতিরোধ সেই সময় শুধু আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের উপর নির্যাতণ-নিপিড়ন ও জেল জুলুম অত্যাচার নিয়ন্ত্রণে বাধ্য হয়নি, গোটা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ কে বেঈমান, বিশ্বাস ঘাতক উপাধি থেকেও রক্ষা করেছে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর তাঁর রক্তের উপর পা রেখে বেঈমান, বিশ্বাস ঘাতক, ক্ষমতা লোভি খন্দকার মোশতাকের অবৈধ সরকারের শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন এইচ টি ইমাম, যিনি আওয়ামী লীগের সরকারের শাসনামলে এমপি হয়েছিলেন, পরলোক গমনের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য বঙ্গবন্ধু হত্যার পর টেঙ্কের উপর উঠে উল্লাসি হিরু, বঙ্গবন্ধুর পিঠের চামড়া তুলা এক নেত্রীসহ আত্মরক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি দেওয়া নেতা-নেত্রীরা আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে এমপি-মন্ত্রী হয়ে ক্ষমতার দাপটে ধাপিয়ে বেরিয়েছেন অথচ আজও অবহেলিত ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যোদ্ধারা।
কি দোষ তাঁদের? বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যোদ্ধাদের নিয়ে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। টানা দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার পরেও পঁচাত্তরের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কেন মূল্যায়ন করা হয়নি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ এর শসনামলে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যোদ্ধারা কি প্রকৃত পক্ষে আসলেই দৃস্কৃতিকারী? তাহলে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শাস্তি দিন, নয় রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিন।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত এবং ইতিহাসের সাথে তামাশা করা হচ্ছে।
প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে যে সকল বীর যোদ্ধা শহীদ বরণ করেছেন তাদের সঠিক তালিকা করে রাষ্ট্রীয় ভাবে শহীদের মর্যাদা ও প্রতিবাদ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।
মন্তব্য