সব
জালিয়াতির মহা-আখড়ায় পরিণত হয়েছে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। অনিয়ম ও দুর্নীতির সকল মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠান। এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর একদিন আগে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ২৫০ ফরম ফিলাপ করার ঘটনা ঘটেছে। এক এক করে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল।
সূত্র মতে, কলেজ বিভাগ ও বিষয় পরিবর্তন করে প্রশ্নবিদ্ধ ফরম ফিলাপগুলো করা হয়। চক্রটি টাকার বিনিময়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পর্যায়ক্রমে ৪৫০ ফরম ফিলাপ করার সুযোগ করে দিয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অন্যদিকে বিধি অনুযায়ী হয়নি কোনো টিসি ও রেজিস্ট্রেশন কার্ড পরিবর্তন। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে আবেদন, প্রতিষ্ঠান প্রধানদের জাল সই ও সিল ব্যবহার করা হয়। মোটা অংক নিয়ে এ কাণ্ড ঘটায় বোর্ডের ‘বিশেষ চক্র’। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে এটি নজিরবিহীন ঘটনা।
সূত্র মতে, মোটা অংক নিয়ে বোর্ডের সার্ভার প্যানেলে পরিবর্তন এনে প্রশ্নবিদ্ধ কাজ চলে গত শনিবার রাত পর্যন্ত। এর আগে ২৭ জুন পর্যন্ত একই কাণ্ড ঘটিয়ে ২ শতাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশ্নবিদ্ধ ফরম ফিলাপ করার সুযোগ দেওয়া হয়। বিষয়টি ‘টক অব দ্য বিভাগ’। ভেঙে পড়েছে বোর্ডের চেইন অব কমাণ্ড। নেই কোনো সমন্বয়। কর্মকর্তাদের অফিসে না পেয়ে হয়রানির শিকার হন সেবা প্রত্যাশীরা। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিনিয়র-জুনিয়র কেউ কাউকে মানতে নারাজ।
জানা যায়, দেনদরবারের পর বৃহস্পতিবার রাত ১০ টায় ময়মনসিংহ বোর্ডের তথ্য প্রযুক্তি শাখার সংশ্লিষ্টরা অবৈধ সুবিধা নেওয়া পরীক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড পরিবর্তনের কাজ শুরু করেন। শুক্রবার ভোর ৬ টায় বন্ধ হয়ে জুমার নামাজের পর আবারো কাজ শুরু হয়। রেজিস্ট্রেশন কার্ডের কাজ চলে রাত দেড়টা পর্যন্ত। ফরম ফিলাপের পর ময়মনসিংহ ও জামালপুরের অধ্যক্ষরা পর্যায়ক্রমে কেন্দ্র সচিবদের কাছ থেকে রিলিজ হওয়া প্রবেশপত্র সংগ্রহ করেন। বিপত্তি ঘটে ১০ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে। তড়িঘড়ি সার্ভার প্যানেলে কলেজ, বিভাগ, বিষয় ও ছবি যুক্ত করার সময় ত্রুটির ঘটনা ঘটে।
আবেদন নিয়ে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ত্রুটি সংশোধন করে পুনরায় প্রবেশপত্র রিলিজ দেওয়া হয়। ফরম ফিলাপ কাণ্ডের সময় উপ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উচ্চ মাধ্যমিক) এস.এম. মোবাশ্বির হোসেন, সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু সায়েম মোহাম্মদ হাসান, সহকারী কলেজ পরিদর্শক মোঃ নাজমুল হক ভূঁইয়া, সহকারী প্রোগ্রামার মোঃ মনোয়ারুল ইসলাম ও বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ তথ্য প্রযুত্তি শাখায় উপস্থিত ছিলেন।
অসুস্থ থাকার পরও সহকারী প্রোগ্রামার রাত জেগে প্রশ্নবিদ্ধ কাজ করতে বাধ্য হন।
সূত্র জানায়, অবৈধ সুবিধা পাওয়ার আশায় নির্ধারিত সময়ে ফরম ফিলাপ না করা একদল শিক্ষার্থী গত বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৩ টায় ময়মনসিংহ বোর্ডের মূল ভবনে জড়ো হয়। চেয়ারম্যানের জন্য অপেক্ষা করে না পেয়ে তারা তথ্য প্রযুক্তি শাখার কাজ বন্ধ করে দেয়। ঘিরে রাখে দখল করার স্টাইলে। বন্ধ হয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজ। সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়াতে চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ আবু তাহের সন্ধ্যায় অফিসে যান। অধ্যক্ষদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অনুমোদিত টিসি থাকার শর্তে কলেজ, বিভাগ ও বিষয় পরিবর্তনের অনুমতি দেন। বিশেষ চক্রটি মুহুর্তের মধ্যে খবর পৌঁছে দেয় ময়মনসিংহ নগরী, তারাকান্দা ও জামালপুরের কয়েক কলেজ অধ্যক্ষের কাছে। কাগজপত্র নিয়ে তারাও বোর্ডে যান। এক এক করে রেজিস্ট্রেশন কার্ড পরিবর্তনের সংখ্যা দাঁড়ায় আড়াই শতাধিক। পোয়াবারো হয় চক্রের অবস্থা। চেয়ারম্যানসহ অন্যদের নামে আবারো নেওয়া হয় টাকা। এর পরই রাত জেগে ‘সেবা’ দেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কলঙ্কিত হয় ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড।
জানা যায়, ময়মনসিংহ বোর্ডের কলেজ ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাখার ৪ কর্মকর্তার কারণে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে নানান কাণ্ড শুরু হয়। প্রশ্নবিদ্ধ টিসি, বিভাগ ও বিষয় পরিবর্তনের ‘হাট’ বসিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। মূল ভবন থেকে কলেজ ও পরীক্ষা শাখা ২ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় প্রকাশ্যেই চলে ঘুষ লেনদেন। ৩ মাসে ময়মনসিংহ ও জামালপুরের কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং দালালদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় অন্তত: ২০ লাখ টাকা। বোর্ডের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ অন্য কর্মকর্তা ও সিন্ডিকেটের নাম ভাঙিয়ে ঘুষ নিলেও ৪-৫ লাখ ‘সালামি’ ও ‘বখরা’ দিয়ে পুরোটাই নিজের করে নেন ‘চটপটে’ ও ‘মিষ্টভাষী’ এক কর্মকর্তা। ‘চতুরতা’ থেকে রক্ষা পান নেত্রকোণা ও শেরপুরের কলেজ কর্তৃপক্ষ।
সূত্র মতে, তার কাছে ধরাশায়ী হন কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর প্রানেশ রঞ্জন রায়। বখরা নিয়ে তাদের মধ্যে ঘটে বাক-বিতণ্ডা। শাখা প্রধানকে পাশ কাটিয়ে চেয়ারম্যান ও সচিবের আস্থাভাজন হয়েছেন ‘গলাবাজ’ এই কর্মকর্তা। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শাখার ‘সাইলেন্ট কিলার’ এক কর্মকর্তাও হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ লাখ টাকা। তথ্য প্রযুক্তির সহযোগিতা ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করলেই অনেক কিছুর প্রমাণ পাওয়া যাবে।
সূত্র জানায়, পরীক্ষার রুটিন প্রকাশের পরই কৌশলে টিসির দায়িত্ব নেন প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তা। মে মাসের শেষ দিকে ২ শতাধিক শিক্ষার্থীর টিসি, বিভাগ ও বিষয় পরিবর্তনের খবর জানতে পেরে বেঁকে বসেন চেয়ারম্যান। বন্ধ করেন কার্যক্রম। সার্ভারে ত্রুটির কথা বলে অধ্যক্ষদের সময়ক্ষেপন করানো হয়।
অন্যদিকে শীর্ষ কর্মকর্তা ৫ লাখ টাকা ‘নজরানা’ নিয়ে ভালুকার প্রশ্নবিদ্ধ ২ কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থীর বিভাগ ও বিষয় পরিবর্তন করে নতুন রেজিস্ট্রেশন কার্ড প্রদান করেন।
সূত্র মতে, বিশেষ সুবিধা নেওয়া অধ্যক্ষরা ২৪ জুন পর্যন্ত ওই কর্মকর্তার কাছে ধর্ণা দেন। চেয়ারম্যান ঢাকায় ছিলেন। তার পরামর্শে ময়মনসিংহ ও জামালপুরের ২ অধ্যক্ষ ও এক দালাল ঢাকায় গিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেন। অবৈধ কর্মকাণ্ডের অনুমতি না পেয়ে তারা ফিরে আসেন। ২৭ জুন বোর্ডের মূল ভবনে হট্টগোল করানো হয়। পরে শর্তসাপেক্ষে মানবিক কারণে ফরম ফিলাপ কার্যক্রমের অনুমতি দেন চেয়ারম্যান। ‘মিশন সফল’ হওয়ার পর ‘চতুর’ কর্মকর্তাসহ বিশেষ চক্রটি আবারো টাকার নেশায় মেতে ওঠে। মোবাইলে কল করে কলেজ অধ্যক্ষদের ডেকে এনে রেজিস্ট্রেশন কার্ড পরিবর্তনের ব্যবস্থা করে দেয়।
জানা যায়, প্রশ্নবিদ্ধ ফরম ফিলাপ কার্যক্রমে জামালপুর শীর্ষে। ৫ কলেজের দেড় শতাধিক পরীক্ষার্থীকে সুবিধাজনক কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে হাতিয়ে নেওয়া হয় অর্ধ কোটি টাকা। শীর্ষে বেলটিয়ার শাহাবুদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল ইসলাম সেলিম। অনুমোদনহীন এই কলেজ থেকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ না থাকায় সরিষাবাড়ি ও ইসলামপুরের ৪ কলেজ থেকে ১৩০ জনকে পরীক্ষা দেওয়ানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন কার্ড ও প্রবেশপত্র না পাওয়ায় ঘটে বিপত্তি। কলেজ ঘেরাও করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পরিচালনা পর্ষদ অধ্যক্ষ সেলিমকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। একইভাবে ফরম ফিলাপ কাণ্ড ঘটান জামালপুরের এফএম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ ফেরদৌস আলী ও ইসলামপুরের ৪ নং চর হাই স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হাকিম।
ময়মনসিংহের কলেজগুলোর মধ্যে তারাকান্দার এইচ.এ ডিজিটাল কলেজ অন্যতম।
সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ বোর্ডে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র ৯৯টি। গত বছর ছিলো ৯২টি। বেড়েছে ৭টি। জামালপুর সদরে ৩টি, ময়মনসিংহ নগরীতে ২টি ও ভালুকায় ২টি। এগুলো হচ্ছে- ময়মনসিংহ নগরীর শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ ও মহাকালী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, ভালুকার সায়েরা সাফায়েত উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উথুরা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ এবং জামালপুর সদরের বঙ্গবন্ধু আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, শহীদ জিয়াউর রহমান ডিগ্রি কলেজ ও নান্দিনা নেকজাহান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। এর মধ্যে ৫টি কেন্দ্রের জন্য ২৫ লাখ টাকা লেনদেনের খবর নিশ্চিত করেছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। তার মধ্যে জামালপুরের ২টি ও ভালুকার ২টি কেন্দ্র নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই।
অভিযোগ সম্পর্কে বোর্ডের সচিব প্রফেসর কিরীট কুমার দত্ত ও চেয়ারম্যান প্রফেসর মোঃ আবু তাহের বলেছেন, অভিযোগ সঠিক নয়। তবে বড় কোনো কাজ করতে গেলে সামান্য ত্রুটি হতেই পারে। অভিযোগের সত্যতা পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
মন্তব্য