সব
Exif_JPEG_420
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী ইউনিয়নের পূর্ব কৈখালী গ্রামে অসহায় দিনযাপন করছে বাঘ বিধবা মাজিদা,প্রায় ৩০ বছর আগে বিকেল গড়িয়ে ক্রমশ সন্ধে নামছে,পাখিদের ইতস্তত ডাক নীরবতা ভাঙছে,সংকীর্ণ খাঁড়ির মুখে নৌকার গতি একটু কমতেই সবার নজর এড়িয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটা দিয়েছিল মজেরআলী।
কেন যে হাঁটা দিয়েছিল, তা সৃষ্টিকর্তাই জানে,মৃত্যুর ডাক বোধহয় একেই বলে,মোমিন গাজী, আয়ুবআলীরা যখন দেখল মজেরআলী ডোরাকাটা বাঘ ধেয়ে আসছে তার দিকে।
দেখামাত্র হাতের কাছে বাঁশ, লাঠিসোঁটা যা ছিল তা নিয়ে তেড়ে গেল তারা,কিন্তু কাদা ঘেঁটে ছুটে ঘটনাস্থলে পৌঁছনো সহজ ছিল না,ক্ষিপ্র বাঘ এসে থাবা মারল মজেরআলীর ঘাড়ের কাছে,বেশ শক্ত-সমর্থ আর সাহসী মজেরআলী কিছুক্ষণ ব্যর্থ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করল।
কিন্তু বাঘের সঙ্গে খালিহাতে কাঁহাতক লড়া যায়,বাঘ তাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম করল,ততক্ষণে বাঘটিকে ধাওয়া করেছে মজেরআলীর সঙ্গীরা।
প্রবল চিৎকার এবং লাঠিসোঁটা দেখে বাঘ কিছুটা ভয় পেয়ে মিলিয়ে গেল বনের অন্দরে,দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা পরে মজেরালীর ছিন্নবিন্ন রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে নৌকায় চাপিয়ে নিয়ে এসেছিলো তার নিজ বাড়িতে,মজেরালীর পরিবারে তার ১ স্ত্রী, ১ছেলে, ২ মেয়ে ছাড়া ছিলো না তার কোনো আপন ভাই বোন চরম বিপাকে পড়ে তার স্ত্রী মাজিদা বিবি।
নিজের অতীতের কথাগুলো ভাবছিল মজেরআলীর বউ মজিদা বিবি,ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়েই এ ভাবে একদিন স্বামীহারা হয়েছিল সে আজ ও সরকারি কোনো সহায়তা পায়নি মাজিদার দাবী।
তারপর রঙিন পোশাক রেখে পরতে হয়েছিল বিধবা সাজ,আজও চোখের সামনে দুঃস্বপ্নের মতো ভেসে ওঠে সব,স্বামীর খুবলে খাওয়া শরীর আজও তাড়া করে বেড়ায় ঘুমের মধ্যে।
একটা বিশ্বাস ক্রমশ স্থির হয়েছে তার মনে, কোনও অপদেবতা ভর করেছিল বাঘের মধ্যে, সেই অপদেবতাই তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে। নিশ্চিত ভাবে কোনও পূর্বজন্মের অভিশাপে তাকে অকালে স্বামীহারা হতে হয়েছে।
পেটের টানে সুন্দরবন সংলগ্ন দ্বীপ অঞ্চলের মানুষগুলোকে ঘুরে বেড়াতে হয় জঙ্গলে, খাঁড়িতে। একটু অসতর্ক হলেই বাঘের হামলায় মৃত্যু যেন নিয়তির মতোই ধ্রুবসত্য।
জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে, দ্বীপে কাঁকড়া ধরতে গিয়ে সব সময়ে এই সীমারেখা ঠাহর করতে পারেন না স্থানীয় মানুষরা,বাঘও শিকারের দিকে তীক্ষ্ণ নজরদারি রেখে ঝোপেঝাড়ে ওঁৎ পেতে থাকে।
একটু অসাবধান হলেই বিপদ,বাঘ-মানুষের এই চিরন্তন প্রাকৃতিক সংগ্রাম,যেন দু’পেয়ে-চার’পেয়ের ধরাধরি খেলা,কিন্তু এর পরিণতি স্বরূপ যে বৈধব্য, সাদা থানে আবৃত হয়ে কাটানো বাকি জীবন, সেখানে অভাব, নিঃসঙ্গতা থাবা মারে প্রতিনিয়ত,সেই রক্তক্ষরণ চট করে দৃশ্যমান হয় না৷
বাঘে স্বামীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরও নিস্তার নেই। শোক সামলে আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য চেয়ারম্যান মেম্বার ও অবস্থাশালী লোকদের হাতেপায়ে ধরাধরি,প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য হলে সংসার চালাতে, সন্তানদের ভাত জোগাতে এই মহিলারাই উদ্যোগী হন।
বাঘের পাশাপাশি কুমিরের ভয়। মাছ ধরার সময় কুমিরে টেনে নিয়ে যায় মাঝেমধ্যে৷
এই অন্ধকারে আশার আলো বাঘ বিধবাদের একটু সরকারি সহায়তা।
কিন্তু মাজিদার দাবী তার স্বামীকে বাঘে ধরার পরে এবং বিধবা হওয়ার পর এখন ও পর্যন্ত কোনোরকম সরকারি বেসরকারি সহায়তা পায়নি,দৈনিক সাতঘরিয়া প্রতিনিধিকে জানান একটু সহায়তা পেলে কিছুটা হলে ও সে অসহায় দিনযাপন ও অসুস্থ শরীরের চিকিৎসা করতে ইচ্চুক মাজিদা সরেজমিনে দেখা যায় বাঘ বিধবা মাজিদা এখন অসুস্থ বয়স আর স্বামীহারা বেদনায় শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা রোগ।
স্বামীসুখ থেকে বঞ্চিত মাজিদাদের জীবনে শূন্যতা গিলে খায়,স্বামী না থাকার ব্যথা, কোলের সন্তানের ফ্যাকাশে মুখে তৈরি হয় অপুষ্টির ছায়া। সুন্দরবনের গর্ভে রয়েছে বিধবাদের কষ্ট মন ভরা বেদনা ছড়িয়ে জনশ্রুতি,লোকমুখে নানান গল্প। যেখানে মাজিদারা হারানো স্বামীর স্মৃতি আগলে বেঁচে আছেন,বাঘের আক্রমণে স্বামী হারানোর পর, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিজেরাই পেটের তাগিদে ছুটছেন মানুষের দারে দারে।
সন্দরবন এলাকায় হাতের মুঠোয় জীবন, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ,বেঁচে ফিরে আসা,আবার গিয়ে দাঁড়ানো মৃত্যুর দুয়ারে,চক্রাকারে চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া ৷
মন্তব্য