সব
কোনো বড়সড় ঘটনা ছাড়া অনেকটা নিরাপদেই পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হলো। ঝড়তুফানে যদিও কিছুটা অসুবিধা হয়েছে। তবু মোটামুটি নিরাপদেই মুসলমানদের সব থেকে বড় পবিত্র অনুষ্ঠানটি নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও বাবা-মার কবরে গিয়েছিলাম।
সঙ্গে ছিল দীপ-কুঁড়ি-কুশি। ওদের মা মাসখানেক হলো সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বেশ ব্যথা পেয়েছেন; যা এখনো পুরোপুরি ঠিক হয়নি। ঢাকার কুঁড়েঘরের মতো ছোট্ট বাড়িতে তেমন চলাফেরা করতে না পারলেও টাঙ্গাইল এসে অনেক নড়াচড়া করছেন। তাতে কিছুটা হলেও ভালো বোধ করছেন।
আমার স্ত্রী নাসরীন বেশ মজলিসি স্বভাবের মানুষ। কাউকে পেলেই খুব উৎসাহী হন, প্রাণ খুলে আলোচনা করেন। বিশেষ করে ছেলেবেলার বন্ধুদের পেলে তিনি অন্য জগতে চলে যান। তার কাছে ধনী-গরিব নেই, জাত-বেজাত নেই।
যেমন অনেক অনেক বড়লোক বন্ধু আছেন, তেমনি একেবারে নিঃস্বরিক্ত বন্ধুরও অভাব নেই। রতনগঞ্জের অঞ্জলী দেখতে চমৎকার। মানুষ হিসেবেও অসাধারণ। গায়ের রং দেবী মা কালীর মতো। কিন্তু আমার স্ত্রীর সঙ্গে তার যে সম্পর্ক কল্পনা করা যায় না।
নায়ক-নায়িকার মতো সুন্দর বন্ধুদের চাইতে অঞ্জলী তার কাছে অনেক প্রিয়। আর অঞ্জলীকে আমিও নানাভাবে দেখেছি। অঞ্জলীর রতনগঞ্জের বাড়ি থেকে পুব-দক্ষিণে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে আমার কালিয়ানের ঘাওগাচালার বাড়ি। ওদিকে গেলে সে জানবেই এবং এটাওটা হাতে করে হাজির হবে। অসাধারণ তার ব্যবহার। প্রতি বছরই ঈদের দিনে মা-বাবার কবরে যাই ফাতেহা পাঠ করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করি। এবারও করেছি। কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে দীপ-কুঁড়ি-কুশিকে বলেছিলাম, আমাকেও এখানে কবর দেবে মা-বাবার পায়ের কাছে। জানি না ওরা আমার কথাটা কীভাবে নিয়েছে। আমার তিন ছেলেমেয়েই প্রায় একই রকম। খুব একটা বোঝা যায় না। নিজেরা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায়। তবে মানুষ হিসেবে তিনজনই একই রকম। অন্যের প্রতি মায়ামমতায় ভরপুর। কাউকে তেমন ছোট মনে করে না। খাওয়াদাওয়া চলাফেরায় কোনো বড় ভাব নেই, গরিমা নেই। ছোটটা তো একেবারে আদর্শ মানুষ। কারও কষ্ট, অভাব সে দেখতে পারে না। তার সামনে কোনো অভাবী মানুষ পড়লে যতক্ষণ তাকে কোনো সাহায্য করতে না পারবে ততক্ষণ কোনো স্বস্তি পাবে না। দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করতেই থাকবে। কাউকে কোনো কিছু দিলে তা তার কাছে পর্যাপ্ত মনে না হলে ছুটে যাবে ভাইবোনের কাছে। সেখানেও তার মনমতো কিছু না হলে আমাকে এসে ধরে, ‘আব্বু এটা কর, ওটা কর। একটা লোক এসেছে তার খুব কষ্ট। ’ আর কুশিমণি আমার বুকে আসার পর মনে মনে শপথ করেছি ওকে কোনো ব্যাপারে না বলব না। এতদিন তা-ই করে এসেছি। আল্লাহর অশেষ দয়ায় কোনো ব্যাপারে ওকে না বলতে হয়নি। টাকা চাইলে জিজ্ঞেস করিনি, টাকা দিয়ে তুমি কী করবে। আমার কুশিমণি বড় হয়েছে। এখন সে দশম শ্রেণিতে পড়ে। ও যখন বুকে এসেছিল পরম দয়ালু আল্লাহর কাছে ভীষণ কান্নাকাটি করেছিলাম, হে আল্লাহ! তুমি বাচ্চাটাকে একটু বড় করে যাওয়ার সুযোগ দিও। আল্লাহ যথেষ্ট সময় দিয়েছেন। এখন অবাক হই, ছোট্ট এক টুকরো মাংস কীভাবে দিনে দিনে একটা মানুষ হতে চলেছে। সারা বাড়ি আগলে রেখেছে। সবাই তাকে ভালোবাসে। কাজের লোকসহ আমরা সবাই কুশির জন্য খুশি। আমাদের কুশি ভালো তো আমরা সবাই ভালো। পবিত্র ঈদেও কুশিকে নিয়ে আমরা যথেষ্ট আমোদ-ফুর্তি করেছি। কুশি দশম শ্রেণিতে ওঠায় ওর ভাই দীপ আমাদের সবাইকে আলাদা করে খাইয়েছে। একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমাদের বেশ ভালো লেগেছে। ঢাকায় থাকার জন্য বড় ভাই ও মুরাদ উপস্থিত হয়নি। আর সবাই হাজির হয়েছে।
ঈদের সময় কেন জানি না শত চেষ্টার পরও রাস্তাঘাটে লাখো লাখো মানুষের কষ্ট হয়। ২১ জুন ছিল বাসাইলে পৌর নির্বাচন। আমরা গামছা নিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আওয়ামী লীগের প্রার্থী একসময় জাসদ করা অনেক আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা গণবাহিনীর সদস্য আবদুর রহিম, অন্যদিকে বিএনপির এনায়েত করীম অটল। ২১ জুনের বাসাইলের নির্বাচন সত্যিই অবাধ নিরপেক্ষ হয়েছে। মানুষ ভোট দিয়েছে তার ইচ্ছামতো। সেখানে বাসাইল-সখিপুরে গামছা জয়যুক্ত হয়েছে। আমরা যেমন দলীয়ভাবে খুশি হয়েছি, সাধারণ মানুষও যথেষ্ট খুশি হয়েছে। নির্বাচনের শুরুতেই বিএনপির প্রার্থীকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাদের কঠিন কড়া বহিষ্কারাদেশ আমার তেমন ভালো লাগেনি। তবু তারা করেছে। দলীয় সিদ্ধান্ত মানেননি তাই আপনাকে বহিষ্কার করা হলো এটুকু লিখলেই যথেষ্ট হতো। কিন্তু সেখানে লেখা হয়েছে আগামী দিনে গণতন্ত্র উদ্ধারের সংগ্রামে আপনাকে বেইমান, বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর বলে বিবেচনা করা হবে। এত গালাগালি আমার কাছে শোভন মনে হয়নি। বেশ কিছুদিন পর ২২ জুন ঢাকা গিয়েছিলাম। ঢাকার কাজকর্ম সেরে ২৬ জুন সকালে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে রওনা হয়েছিলাম। একেবারে বাধাহীন টাঙ্গাইলে পৌঁছি দুই ঘণ্টায়। অথচ ২৬ তারিখ সন্ধ্যায়ই শুরু হয়েছিল তীব্র যানজট। যানজটপ্রবণ সব জায়গায়ই পুলিশকে সতর্ক দেখেছি। তার পরও টাঙ্গাইলে ফেরার পথে রাস্তার দুই পাশে যে শত শত বাস-ট্রাক দেখেছিলাম সেগুলো যখন যাত্রী নিয়ে বের হয় তখন আর সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ছয়-সাত ঘণ্টার যানজট লেগে যায়। ২৭ তারিখে তো সেটা প্রায় ১২-১৪ ঘণ্টায় গিয়ে ওঠে। শত চেষ্টায়ও বঙ্গবন্ধু সেতুর যানজট কিছুতেই নিরসন করা যায়নি। জানি না এর কীভাবে পরিসমাপ্তি হবে। কিন্তু প্রতি ঈদেই এমন অভাবনীয় যানজট সহ্য করা যায় না।
এবার কেউ মাঠে নামাজ পড়তে পারেনি। প্রায় সবাই মসজিদে মসজিদে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করেছে। আমিও করেছি। নামাজ আদায় করে কোরবানি দিয়ে বাবা-মার কবরে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে তেমন গাড়িঘোড়া ছিল না। কিন্তু ঢাকার দিক থেকে একের পর এক ট্রাক পিকআপ ফিরছিল শত শত গরু নিয়ে। এবার ঈদে অনেকেই গরু বিক্রি করতে পারেনি। দামের ছিল খুবই ওঠানামা। অনেকটা কাঁচা মরিচের মতো। হায় আল্লাহ! ১৯৬২-৬৩ সালে আমি যখন বাজার করতাম তখন কাঁচা মরিচ ছিল এক-দুই আনা সের। এক সেরের ওপরে ইলিশ মাছ ছিল এক টাকা আর এখন সেই ইলিশ ১৬০০-১৭০০ কিংবা আরও বেশি। এক আনার কাঁচা মরিচ এখন হাজার টাকা! এটা ভাবা যায়? মানুষের কল্পনারও বাইরে। এই যদি হয় বাজারমূল্য তাহলে সাধারণ মানুষ চলবে কী করে? আদা-মরিচ-পিঁয়াজ-রসুন কারও ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। সাধারণ মানুষ করছে হাহাকার। আমরা রাজনীতিবিদরা অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েছি। এখন রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই। বিত্তশালী ব্যবসায়ীরা রাজনীতির গলা টিপে ধরেছেন। এদের দ্বারা কোনোমতেই বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা না, নেইও। তাই এবারের ঈদ তেমন কেউ ভালোভাবে করতে পারেনি। কিন্তু শান্তিশৃঙ্খলার কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। সেজন্য আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া। আল্লাহ আমাদের নিরাপদে ঈদের সব আনুষ্ঠানিকতা পালনে সাহায্য করেছেন সেজন্য শত সহস্র কণ্ঠে পরম দয়ালু আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
পরম করুণাময় আল্লাহ কখন কাকে দিয়ে কী কাজ করান তা তিনিই জানেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় রাখাল চন্দ্র নাহার ফাঁসির আদেশ কার্যকরের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এক সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫-২০ জন ছাত্রছাত্রী এসেছিল আমার মোহাম্মদপুরের বাড়িতে। পরদিন রাতে রাখাল চন্দ্র নাহার ফাঁসি কার্যকর হবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি স্থগিতের এক বিরাট আশা নিয়ে তারা এসেছিল আমার কাছে। রাত সাড়ে সাত-আটটা হবে। আগন্তুকদের কথাবার্তা শুনে তাদের কথায় যুক্তি আছে বুঝতে পেরে তখনই বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। এ রকম অনির্ধারিতভাবে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যায় এটা আমার জানা ছিল না। তবু গিয়েছিলাম। তখন ৯টা বাজতে দু-চার মিনিট বাকি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে চাই এটা বলতেই তারা সবাই পরম আন্তরিকতার সঙ্গে ছোটাছুটি করে ১০ মিনিটের মধ্যেই মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। রাষ্ট্রপতিকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার পরদিন ফাঁসির আদেশ কার্যকর হওয়ার কথা বললে তিনি খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলেন, সিদ্দিকী সাহেব! আপনি সোজাসরল মানুষ। আপনারা রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন তাই আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। আমার কোনো কিছুই করার ক্ষমতা নেই। আমি শুধু ফাইল স্বাক্ষর করি। আমি বঙ্গভবনের একজন পিয়নকেও সরাতে পারি না। সবকিছু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে। পরদিন সকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ফখরুদ্দীন আহমদের তেজগাঁওয়ের অফিসে গিয়েছিলাম। তিনিও মহামান্য রাষ্ট্রপতির মতো বলেছিলেন, সিদ্দিকী সাহেব! আপনি হয়তো মনে করেন আমি সবকিছু করতে পারি। কিন্তু না, যা কিছু করার উত্তরপাড়া হতে করা হয়। পারলে আপনি সেখানে যান। সেখান থেকেই ছুটে গিয়েছিলাম ক্যান্টনমেন্টে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদের কাছে। তারা যথেষ্ট সমাদর করেছিলেন। কথাটি শোনার পর মইন উ আহমেদ বলেছিলেন, আমরাও একজন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি চাই না। আমি বসে থাকতে থাকতেই সেনাপ্রধানের দফতর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান ফখরুদ্দীন আহমদকে রাখাল চন্দ্র নাহার ব্যাপারে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। পরদিন সারা দিন তেমন কোনো খবর পাইনি। মারাত্মক উৎকণ্ঠায় কেটেছিল। রাত ১০টায়ও যখন কোনো কিছু জানতে পারিনি তখন খুব উতালা হয়ে পড়েছিলাম। যেখানে যেখানে যোগাযোগ করা সম্ভব করেছিলাম। কিন্তু ভালোমন্দের কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। মনে হয় পৌনে ১১টার দিকে বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন আসে, রাখাল চন্দ্র নাহার ফাঁসির আদেশ স্থগিত করে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। বেশ স্বস্তি পেয়েছিলাম। দু-তিন দিন পর কুমিল্লা সেন্ট্রাল জেলে গিয়েছিলাম রাখাল চন্দ্র নাহাকে দেখতে। একেবারে হাড্ডিসার একজন মানুষ। সব কথাতেই ভগবানের ওপর তাঁর বিশ্বাস। যে মামলায় তাঁকে দন্ড দেওয়া হয়েছে সে মামলার কোনো কিছুই সে জানে না। যেদিন খুন হয়েছে সেদিন সে বাড়িতে ছিল না। অনেক দূরে আত্মীয় বাড়িতে ছিল। অনেকটাই শত্রুতা করে তাঁকে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। এটা আজ থেকে ১৫-১৬ বছর আগের ঘটনা। তারপর সব সময় চেষ্টা করেছি কোনো জাতীয় দিবসে অথবা অন্য কোনোভাবে রাখাল চন্দ্র নাহাকে মুক্ত করা যায় কি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে আমি আমার ভাইয়ের মতো ভালোবাসি, স্নেহ করি। তিনিও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। যে কারণে মাঝেমধ্যে তার কাছে যাই। যখন যে কথা বলেছি তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে সেটা শোনার চেষ্টা করেছেন। বয়স হয়ে গেছে আমরা আর কী চাই? আমরা শুধু এটুকুই চাই নতুনরা যত্ন নিয়ে আমাদের কথা শুনুন। কিছু সহযোগিতা করতে পারলে করুন, না পারলে না করুন। এসব ক্ষেত্রে আসাদুজ্জামান খানকে শতভাগ সঠিক দেখেছি। বিশেষ সুবিধায় একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাখাল চন্দ্র নাহাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফাইল আইন মন্ত্রণালয়ে অনেকবার গেছে। কিন্তু মাননীয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ফাইলটি অনুমোদন করতে পারেননি বা করেননি। তাঁর যুক্তি ছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একজন একবারই রেয়াত পেতে পারেন। তাঁকে ফাঁসির আদেশ পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়েছে। তাই আর কোনো কিছু করার ক্ষমতা আইন মন্ত্রণালয়ের নেই। আমি মাননীয় মন্ত্রী আনিসুল হককে কখনো চিনতাম না। আমি চিনতাম তাঁর বাবা অ্যাডভোকেট সিরাজুল হককে। অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক একজন অসাধারণ মানুষ। কলকাতার বেকার হোস্টেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তিনি থাকতেন। তাঁর কাছেই প্রথম শুনেছি, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনার যখন জন্ম হয় তখন কলকাতায় বঙ্গবন্ধু খবর পেয়ে খুবই বিমর্ষ ছিলেন। কী হয়েছে সিরাজুল হক জিজ্ঞেস করায় তাঁকে বলেছিলেন, আমার প্রথম সন্তান হয়েছে। তার জন্য কিছু কেনাকাটা করার পয়সা নেই হাতে। সে সময় সিরাজুল হক তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বাচ্চার জন্য যা যা প্রয়োজন কিনে পাঠিয়ে ছিলেন। স্বাধীনতার পর তাঁর সঙ্গে আমার অনেকবার কথা হয়েছে। অসাধারণ মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে খুন করে যখন খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে তখন এমপিদের ডেকেছিলেন। সেই দাওয়াতে বা আহ্বানে এমপি হিসেবে সিরাজুল হকও গিয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাকের মুখে মুখে বলেছিলেন, তোমাকে আমরা মানি না। তুমি বঙ্গবন্ধুর খুনি। কতখানি বুকের পাটা থাকলে ওই সময় ওইভাবে খন্দকার মোশতাককে কিছু বলা যায়। আরেকজন আবুল হাশেম গফরগাঁওয়ের এমপি খুনি মোশতাককে খুনি মোশতাক, খুনি মোশতাক স্লোগান দিতে দিতে বঙ্গভবনের গেটে প্রবেশ করেছিলেন। যে কারণে তাঁর বুকেও রাইফেল ধরা হয়েছিল। কিন্তু তিনি দমেননি। তাই সব সময় আমার অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি কিছু করেননি। এই এক মাস আগেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এবং আইজি প্রিজনকে বলেছিলাম, রাখাল চন্দ্র নাহার খোঁজখবর নিতে, চিকিৎসা করতে।
গত বছর নাহাকে দেখতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলাম। তাদের ব্যবহার আমার কাছে অভাবনীয় সুন্দর লেগেছিল। শয্যাশায়ী রাখাল চন্দ্র নাহার উন্নত চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পাঠাতে অনুরোধ করেছিলাম। মনে হয় তার পরদিনই তারা রাখাল চন্দ্র নাহাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। ঢাকা মেডিকেলে তাঁর ছোট্ট একটা অপারেশনও হয়েছিল। আমি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে অনেক খোঁজাখুঁজি করে রাখাল চন্দ্র নাহাকে না পেয়ে কেন্দ্রীয় জেলের জেলার মাহবুব সাহেবকে ফোন করেছিলাম। জেলার মাহবুব সহযোদ্ধা নাসিম ওসমানের ভাস্তি বা ভাগনিজামাই। আমাকে খুব ভালোবাসেন, সম্মান করেন। মাহবুব বলছিলেন, সে কেরানীগঞ্জ জেলে আছে। বলেছিলাম পরদিন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পাঠিয়ে দিতে। তিনি তাই পাঠিয়েছিলেন এবং সেখানে অনেকদিন চিকিৎসা হয়। তারপর আবার একসময় কুমিল্লা জেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ২ জুলাই রবিবার দুই যুগ পর মুক্তি পেয়ে বাড়ি গেছে। আমার জীবনে এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহা ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক এ কামনাই করি।
লেখক : রাজনীতিক
www.ksjleague.com
মন্তব্য