সব
সময়ের বিবর্তনের সাথে হরিয়ে যাচ্ছে ময়মনসিংহের জেলার গ্রামবাংলার চিরচেনা ঐতিহ্যবাহি হালচাষ। কোকিল ডাকা ভোরে কৃষকরা লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে মুখে পল্লীগীতি-ভাটিয়ালী গেয়ে মুখরিত করে পথাঞ্চল এক জোড়া গরু-মহিষ নিয়ে বেরিয়ে যেত মাঠে হালচাষ করার জন্য। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমিতে কৃষকের লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ, ভাটিয়ালি-পল্লীগীতি গানের মধুর সুর মাতিয়ে রাখতো হাট-ঘাট ও মাঠ।
কৃষাণীরা সাজিয়ে নিয়ে যেত সকালের নাস্তা আলুবর্তা, ডাল, পিঁয়াজ কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তাভাত ও দুপুরে গরম ভাত। এমনই ছিল গ্রামবাংলার চিরাচরিত বিলুপ্তির পথে সেই অভুতপূর্ব দৃশ্য। এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে না বললেই চলে। সময়ের সাথে দিন বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের জীবনধারা। যুগে এসে গেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিনে পাল্টে যাচ্ছে সব কিছুই।
বিজ্ঞানের অগ্রাযাত্রায় নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ায় বর্তমানে কৃষি কাজেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিকতার স্পর্শে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। নিত্য নতুন আবিষ্কারের ফলে কৃষকদের জীবনেও এসেছে
নানা পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়াও লেগেছে কৃষিতে। তাইতো কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছে সিডার, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারসহ নানান যন্ত্রপাতি। কৃষি প্রধান বাংলাদেশের শতশত বছরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে লাঙ্গল-জোয়াল। চিরায়ত বাংলার রূপের সন্ধান করতে গেলে এই দুই কৃষি উপকরণের কথা যেমন অবশ্যই আসবে, তেমনি আসবে হালের গরুর কথাও।
আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে হাল চাষের পরিবর্তনে এখন ট্রাক্টর অথবা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করা হয়। এক সময় দেশের বিভিন্ন জেলার উপজেলায় বাণিজ্যিক ভাবে কৃষক গরু পালন করতো হাল চাষ করার জন্য। আবার কিছু মানুষ গবাদিপশু দিয়ে হাল চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন।
আবার অনেকে তিল, সরিষা, কালাই, বেলি ও আলু চাষের জন্য ব্যবহার করতেন। নিজের জমি চাষের পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের সংসারের ব্যয়ভার বহন করত। হালের গরু দিয়ে দরিদ্র মানুষ জমি চাষ করে ফিরে পেত তাদের পরিবারের সচ্ছলতা। আগে দেখা যেত কাক আর কোকিল ডাকা ভোরে কৃষক গরু, লাঙ্গল, জোয়াল নিয়ে মাঠে বেরিয়ে পড়তো। এখন আর চোখে পড়ে না গরুর লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদ। জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চলাচ্ছে চাষাবাদ। তাই কৃষকরা এখন পেশা বদলি করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে গরু দিয়ে হালচাষ।
উপজেলার লামাপাড়া গ্রামের কৃষক এমদাদুল হক জানায়, ছোটবেলায় হাল চাষের কাজ করতাম। বাড়িতে হাল চাষের বলদ গরু ২-৩ জোড়া থাকত। চাষের জন্য দরকার হতো ১ জোড়া বলদ, কাঠ আর লোহার সমন্বয়ে তৈরি লাঙ্গল, জোয়াল, মই, পান্টি (বাঁশের তৈরি গরু তাড়ানোর লাঠি), গরুর মুখের লাগাম ইত্যাদি। আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো। চাষের সময় গরুর গোবরের জৈব সার জমিতে পড়ত। এতে করে ক্ষেতে ফলন ভালো হতো। এখন নতুন নতুন মেশিন এসেছে সেই মেশিন দিয়ে এখানকার লোকজন জমি চাষাবাদ করে। আমাদের তো টাকা নাই মেশিন কিনে জমি চাষ করার। তাই এখনো গরু, লাঙ্গল, জোয়াল নিয়ে জমিতে হাল চাষ করি। আগে ২০/২৫ টা হাল বিক্রি করতাম। এখন মাসে ৫টা হালও বিক্রি হয় না। লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ কমে যাওয়ায় এখন সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।
এছাড়াও সাবের উদ্দিন, কাশেম, খালেকসহ আরো কৃষকরা জানান, কৃষি কাজে লাঙ্গলের ব্যবহার পরিবেশ বান্ধব এবং গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যও বটে। আবহমান বাংলার এ প্রাচীন ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে শখের বশে হলেও কৃষকদের মাঝে মধ্যে এ পরিবেশ বান্ধব কাঠের তৈরি লাঙ্গল-জোঁয়াল তুলে নেওয়ার কোন বিকল্প নেই। তবে পুরনো সেই ঐতিহ্য ধরে রাখার নিরন্তর চেষ্টায় এখনো উপজেলার কিছু কিছু হাট-বাজারে ওই সকল কৃষি সরঞ্জামের পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। তবে সেগুলোর চাহিদা কম থাকায় সেই কারিগরা বাধ্য হয়েই চলে যাচ্ছেন ভিন্ন পেশায়। অথচ এমন একদিন ছিল গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে।
এ বিষয়ে উপজেলার বেশ কয়েক প্রবীণ কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গরুর লাঙ্গল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪৪ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। আধুনিক যন্ত্রপাতির থেকে গরুর লাঙ্গলের চাষ গভীর হয়। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার, কীটনাশকের সাশ্রয় হয়। কষ্ট হলেও গরু দিয়ে হাল চাষ করতে খুব ভাল লাগত। বেঁচে যেত অনেক দরিদ্র কৃষকের প্রাণ। এখন মনে পড়লেই অনেক কষ্ট লাগে। ফিরে পাবনা আর সেই পুরনো দিনগুলো। এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য।
মন্তব্য