১৯৮১ সালের ৩০ শে মে, নীড় ভেঙ্গে জিয়াউর রহমান গেছে চলে, সকল বাঙালির হৃদয় মরুভূমি করে। কিন্তু তার গঠিত জেড ফোর্স এর অবদানের কথা মনে পড়লে যেন আজও হৃদয় কাঁপে। জেনারেল এম এ জি ওসমানী প্রবাসী সরকারের সম্মতিতে ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই মেঘালয় রাজ্যের ছোট্ট শহর তুরা থেকেও মাইল দশেক দূরে তেলঢালা নামক বনভূমিতে ১ম, ৩য় এবং ৮ম ই বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধানদের উপস্থিত হতে বলেন। ঐ বৈঠকে উল্লেখিত তিনটি পদাতিক সামরিক বাহিনীকে ইন্টেগ্রেট করে জেড ফোর্স নামক প্রথম দুর্ধর্ষ সামরিক ব্রিগেড গঠিত হয়। মেজর জিয়াউর রহমানের নামের আদ্যক্ষর জেড দিয়ে এই ফোর্সের নামকরণ করা হয়।
ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান ১৯৬৫ সালে সংগঠিত ১৭ দিনব্যাপি পাক—ভারত যুদ্ধে আলফা কোম্পানী’র হয়ে যে বিরুত্বপূর্ন অবদান রাখেন তার স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন পাকিস্তান আর্মির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব ‘হেলালে জুরুত’[ লাভ করেন। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রধান ছিলেন পাকিস্তানী অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়া এবং তার সহকারী কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর জিয়া। ২৫ মার্চ রাত ১১ টায় চট্রগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা ‘সোয়াত’ জাহাজের অস্ত্র খালাস তদারক করার জন্য মেজর জিয়াকে নির্দেশ দেন। নৌবাহিনীর একটি ট্রাক সাথে ২ জন পাকিস্তানী অফিসার ও পাঞ্জাবী ট্রাক চালক সহ রওয়ানা দিলেন। আগ্রাবাদে এসে ট্রাকটি ব্যারিকেডে থেমে গেলো এবং ঐ সময়ে অন্যপ্রান্ত থেকে মেজর খালিকুজ্জামান জানালেন পাকিস্তানীরা ক্যান্টনমেন্টে হামলা শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়া বলে উঠলেন ‘উই রিভোল্ট’। জিয়া তাঁর এসকর্ট অফিসারদের নিরস্ত্র করলেন এবং নিজের জান বাজি রেখে কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়াকে হত্যা করে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং দায়িত্ব নিলেন।
তিনি ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষনা দিলেন: ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম। প্রিয় দেশবাসী, আমি মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও লিবারেশন আর্মির প্রধান হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’ এরপর থেকে সামরিক বাহিনী, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সকলের কাছে মেজর জিয়া পরিচিত হয়ে পড়েন। জেড ফোর্স গঠনের পর দিন থেকে একটানা ২৮ জুলাই পর্যন্ত প্রশিক্ষিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিরোধ যুদ্ধকে জোরদার করার জন্য ডাই হার্ড স্ট্যামিনা আর ডু অর ডাই আত্মপ্রতিজ্ঞায় উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে প্রায় সারাদিন সৈনিকদের ট্রেনিং চলত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রৌমারী মুক্তাঞ্চল হতে প্রায় ১৮০০০ মুক্তিযোদ্ধা জেড ফোর্সের তত্ত্বাবধানে সরাসরি প্রশিক্ষন নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। জেড ফোর্স গঠিত হওয়ার পর থেকে যুদ্ধের দায়িত্ব পড়ে দেশের উত্তর—পূর্ব অঞ্চলে। এই ফোর্স জুলাই—সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর ও রৌমারী এলাকায় যুদ্ধ করে এবং অক্টোবর থেকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলকে মুক্ত এলাকা হিসেবে ঘোষনা করতে সাহসী ভূমিকা রাখে। জেড ফোর্সের অধিনায়ক প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সাথে দু’বার সরাসরি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। প্রথমবার ৩১ জুলাই ১৯৭১ ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীনের সাথে রনাঙ্গনে থেকে শেরপুর জেলায় সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতি উপজেলার কামালপুর গ্রামের নকশী বিওপিতে (বর্ডার আউট পোস্ট) ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে অপারেশন চালান। ঐ দিন ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দীন (বীর শ্রেষ্ঠ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামসুজ্জামান (বীর উত্তম) সম্মূখযুদ্ধে শহীদ হন। কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্য জেড ফোর্সের ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক পদক পেয়েছেন যা অন্য দুটি ব্রিগেড কমান্ড তো দুরের কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আর একটিও নেই। দ্বিতীয়বার ২৮ নভেম্বর ১৯৭১ সিলেটের গৌরিপুরে ৩১ পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। সেই সময় মেজর জিয়া ও ক্যাপ্টেন হাফিজ (বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য) ৩—৪ ঘন্টা একই ব্যাংকারে থেকে যুদ্ধ করছিলেন। ঐ ব্যাংকার থেকে মাত্র ১০০ গজ পূর্বদিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একটি গোলার আঘাতে ক্যাপ্টেন মাহবুব শহীদ হন। ঐ গোলাটি যদি ১০০ গজ পশ্চিম দিকে পড়ত, তাহলে মেজর জিয়া ঐদিন শহীদ হতেন। পাকিস্তানের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল কামালপুরে এবং পুরো মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের কামালপুর অভিযানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুব সহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন। এছাড়াও ঘাসিপুরে ৮০ জন, কোটালকাঠির যুদ্ধে ৭০ জন অসংখ্য সৈন্য হতাহত হয়। ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তাজউদ্দিন আহমেদ পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে জিয়ার নেতৃত্বে যুদ্ধকে স্ট্যালিনগ্রাডের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন নৌ, স্থল ও বিমানবাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী শহরে যে প্রতিরোধব্যুহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর মোকাবিলা করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। তাজউদ্দিন আহমেদ তার ভাষণে আরও উল্লেখ করেন, ‘প্রাথমিক বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম বাঙ্গালী সিনিয়র আর্মি অফিসার যিনি ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন এবং জেড ফোর্সের মাধ্যমে রনাঙ্গনে নিজে যুদ্ধ করেন এবং প্রকৃত যোদ্ধা তৈরি করেন। এমন সাহসী ফোর্স কমান্ডার যে কোন জাতির ইতিহাসে বিরল। জিয়াউর রহমান ছিল মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাস বটবৃক্ষ এবং মহানায়ক। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান কে স্মৃতি বিজড়িত করে রাখার দায়িত্ব এখন এই প্রজন্মের কাঁদে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে তার গঠিত জেড ফোর্সের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রামাণ্য চিত্র, শর্ট ফিল্ম তৈরি করতে হবে, এবং তা পাঠ্যপুস্তকে লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে তা ফুটিয়ে তুলতে হবে।
অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
মন্তব্য