সব
কালীগঞ্জ উপজেলার শিমলা রোকনপুর ইউনিয়নের পুকুরিয়া গ্রামের বদ্দিনাথ শর্মার ছেলে সুজন কুমার শর্মা (২৮) শেষ সম্বল বলতে মাঠে আবাদি জমি ছিলো ১৯ কাঠা ২০২০ সালে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকায় শেষ সম্বল টুকু বিক্রি করে সুদে মহাজনের হাতে তুলে দিয়েছেন তার পরও শোধ হয়নি সুদে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা।
২০১৮ সালে তিনি নতুন বাজারের শাজাহানের সিয়াম সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ এর নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা সুদে নেন। ৫০হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে প্রতি সপ্তাহে ৫হাজার টাকা করে দিতে হতো। এই পর্যন্ত সুজন প্রায় সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়েছেন তারপরও শোধ করতে পারেননি সুদে নেওয়া ৫০ হাজার টাকা।
সুজনের মায়ের ব্যাংক চেকে জোর করে সুজনের স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন শাজাহান সাথে ফাঁকা একটি স্টাম্পেও। সুজন টেলিকম নামের একটি দোকান ছিলো তার সেটিও হাতছাড়া হয়েছে। সব হারিয়ে সে এখন পাগল প্রায়। আত্মীয় স্বজনের কাছে এখন সে চক্ষুসুলের কারন।
নাম প্রকাশে একাধিক ব্যাক্তি জানান, আমরা বিপদে পড়ে তাদের কাছ থেকে টাকা নিই কিন্তু একদিন টাকা দিতে দেরি হলে আমাদের সাথে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
সমবায় সমিতির বিভিন্ন নাম দিয়ে সুদে কারবারিরা খুলেছেন ডেইলি কিস্তির (প্রতিদিন আদায়) সমিতি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে এমন অসংখ্যা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি গড়ে উঠেছে। চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, সাধারন মানুয়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে এইসব সুদে মহাজনরা বিপদ মুহুর্তে চড়া সুদের টাকা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। সুদের টাকা নিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার হলেও আস্তে আস্তে এই সুদের টাকায় যেনো তাদের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। প্রসাশনের নাকের ডগাই চলছে রমরমা এই সব সুদে ব্যবসা। এইসব সমিতির আবার নিবন্ধন নম্বরও রয়েছে।
উপজেলা সমবায় অফিস এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন। এসব ডেইলিকিস্তি সমবায় সমিতির কাছ থেকে টাকা নিতে গেলে গ্রাহককে দিতে হয় একটি সাদা চেক, ১শ টাকার ফাঁকা স্টাম্পে স্বাক্ষর, জীবন বীমা বাবদ ১হাজার ২শ টাকা অফেরত যোগ্য আর এক লক্ষ টাকা লোন নিতে গেলে ১০ হাজার টাকা দিতে হয় সঞ্চয়।
অনেক ভুক্তভোগী জানান, আমাদের টাকা দিতে দেরি হলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হয়। কোন সরকারি ছুটির দিনেও মাপ নেই কিস্তির টাকা দিতেই হবে। ঈদ বা পূজাতেও ছাড় নেই টাকা নেওয়া মানুষ গুলোর। এক লক্ষ টাকা নিলে প্রতিদিন ১২শ টাকা করে গুনতে হয়। এভাবে কোন সমিতি চার মাস আবার কোন সমিতি পাঁচ মাস পর্যন্ত টাকা নিয়ে থাকেন।
আবার কেউ যদি এক লক্ষ টাকা মাসিক হিসাবে নিতে চান তাহলে তাকে প্রতিমাসে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আসল বাদে শুধু সুদ দিতে হয়।
কালীগঞ্জ শহরের সবচেয়ে বড় সুদে মহাজন ঢাকালে পাড়ার সাজাহানের সমিতির নাম সিয়াম সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ যার নিবন্ধন নং- ৪৯/ঝি তাং ০১/১২/২০১৩ কোটচাঁদপুর রোড নতুন বাজার তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই তার অফিস। প্রায়ই দেখা যায় প্রসাশনের বিভিন্ন লোকজন তার আনা-গুনা। অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছে সেই সুযোগটিও কাজে লাগান সুদি সাজাহান।
প্রয়োজন সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং-রেজিঃ ১৫/ঝি তাং- ২১/০৬/২০১২ইং নামে নতুন বাজারে মাসুদ এর আরও একটি সমিতি রয়েছে।
অপর একটি ইউনিক সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড মালিক মোশারফ হোসেনন ওরফে মুসা। যার রেজিঃ নং- ০৬/ঝি অফিস মধুগঞ্জ বাজার দশতলা ভবনের পূর্ব পাশে চার তলায়।
এছাড়াও আশার আলো সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং-রেজিঃ-৩৭/ঝি ০৬/১০/২০২১ইং মধুগঞ্জ বাজার ।
সূর্যের হাসি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং-রেজিঃ২২/ঝি তাং- ০২/০৪/২০১৩ইং কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
চিত্রা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং-রেজিঃ ২৯/ঝি স্থাপিত ২০১৯ইং, একতা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং-রেজিঃ ৪৭/ঝি স্থাপিত ২০১৮ইং, ফয়লা গ্রামে টগর নামের এক দোকানি উন্নয়ন মূখী নামে একটি সমবায় সমিতি নাম দিয়ে তিনি বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মাঝে ৫হাজার থেকে ৫০ হাজার সুদে টাকা দিয়ে থাকেন। তবে তিনি এখনও কোন নিবন্ধন করেননি। দশতলার পাশে বঙ্গমার্কেটে তার দোকান। পৌরসভার নিচিন্তপুরের বিমলের বড় ছেলে মুকুল তিনিও বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের মাঝে সুদে টাকা দিয়ে থাকেন। ফয়লা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং-রেজিঃ৩৮/ঝি তাং- ০৭/১০/২০২১ইং ।
এইসব সমবায় সমিতির একটিরও অফিসে নেই কোন সাইনবোর্ড। দোকান বা বাড়িতেই তাদের কার্যক্রম করে থাকেন।
এছাড়া রিমন নিবন্ধন নং-রেজিঃ ০৪/ঝি সোনারতরী, নিবন্ধন নং-রেজিঃ ৩৩/ঝি, বিবর্তন নিবন্ধন নং-রেজিঃ ০৫/ঝি, এক সময় ঋণদান কার্যক্রম করতো প্রায় ৩/৪ বছর বাদ দিয়েছেন এখন উৎপাদন মুখী উদ্দ্যেক্তা হিসাবে কার্যক্রম করেন। লাইফ কেয়ার নিবন্ধন নং-রেজিঃ ৪৭/ঝি। এই সব সমবায় সমিতির অধিকাংশই ডেইলি কিস্তি (প্রতিদিন আদায়) সুদে কারবারের সাথে ছড়িত।
বন্ধন সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিঃ নিবন্ধন নং-রেজিঃ ৩২/ঝি তাং ৩১/০৭/২০১৪ মালিক মোস্তফার নিকট ডেইলি কিস্তির সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আপনি আগামিকাল সমবায় অফিসে গিয়ে খোঁজ নিবেন। সমবায় অফিস থেকে আমাদের বলে দিয়েছে সাংবাদিক বা প্রশাসনের যে কেউই আপনাদের কাছে গেলে আমাদের অফিসে পাঠিয়ে দিবেন।
এই বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা সমবায় অফিসার আসাদুজ্জামান জানান, আমাদের এখন সমবায় দিবস চলছে। ক্রুটি বিচ্চ্যুতি যেখানে যেটাই আছে আমি ৫ই নভেম্বর সমবায় দিবস শেষে বসে ঠিক করে ফেলবো।
আমরা ইতিবাচক চিন্তা করি আপনারাও ইতিবাচক চিন্তা করেন। আমরা এক জায়গায় বসে সব ঠিক করে ফেলবো।
জেলা সমবায় অফিসার মোঃ জাফর ইকবাল জানান, সমবায় সমিতি তাদের এজিএম এর সিদ্ধান্তের উপর চলবে। কিন্তু কোন ভাবেই ৩০% এর বেশি সুদ নিতে পারবেনা। যদি কোন সমিতি ৩০% এর বেশি সুদ নেই আর আমরা তার প্রমান পায় তাহলে তার নিবন্ধন বাতিলসহ অইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া জেরিন জানান, কালীগঞ্জে সমবায় সমিতি আছে সেটি আমি জানি কিন্তু কেউ সমবায় সমিতির নামে সুদে ব্যবসা করছে কিনা সেটি আমি জানিনা। এমন কোন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
মন্তব্য