সব
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প (এলডিডিপি) বাংলাদেশের বৃহত্তম সরকারি উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের মোট বাজেট ৫,৩৮৯,৯২.৪৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের পশুপালন ও দুগ্ধ শিল্পকে আধুনিকায়ন করা এবং সমগ্র দেশে কসাইখানা, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ও আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের ধারা দেখাচ্ছে, এখানে নিয়ম-নীতি না মানা, দুর্নীতি ও পরিকল্পিত লুটপাটকে কেন্দ্র করে একটি ভয়ঙ্কর অব্যবস্থাপনা তৈরি হয়েছে।
প্রকল্পের দায়িত্বশীল সংস্থা ও মন্ত্রণালয় বারবার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মুখোমুখি হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রকল্পের সিটিসি ডাঃ গোলাম রব্বানীকে দায়ী করে অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা মূল্যের ক্রয় কার্যক্রমকে ব্যর্থ ও অনিয়মিতভাবে পরিচালনা করছেন।
প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে, সরকারের পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী ক্রয় ও প্রকল্প পরিচালনার নিয়মনীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর একাধিকবার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে: অভিযুক্তদের মাধ্যমে তদন্ত এবং প্রতিবেদন তৈরি। প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও মেশিনারির ক্রয়ে অনিয়ম। দরপত্র আহ্বান ও প্যাকেজ নির্ধারণে স্বচ্ছতার অভাব। ডাঃ গোলাম রব্বানী এই প্রকল্পের সিটিসি হিসেবে দায়িত্বে থাকা সত্ত্বেও প্রকল্পের নানা অনিয়মে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষত, প্রকল্পের অর্থায়ন ও ক্রয় কার্যক্রমকে তিনি এমনভাবে পরিচালনা করেছেন যা সরকারের নিয়মানুযায়ী নয় এবং যেখানে কোটি কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে লোপ পাচ্ছে।
প্রকল্পের যন্ত্রপাতি ও ক্রয়ে অনিয়ম : প্রকল্পের অধীনে শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও মেশিনারি সরবরাহ করা হয়নি বা নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে, যদিও সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি আজও প্যাকেটবন্দী বা অকেজো অবস্থায় রয়েছে। সিনিয়র কর্মকর্তা ও ঠিকাদাররা জানান, ডাঃ গোলাম রব্বানী প্রকল্পের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে অনিয়মের পরিকল্পনা করেন। এই অনিয়মের মাধ্যমে প্রকল্পের বাজেটের এক বিশাল অংশ সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে না, বরং প্রশাসনিক জটিলতা ও কর্মকর্তাদের নীরবতা দিয়ে এটি কেবল ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে।
কসাইখানা নির্মাণে অস্বাভাবিকতা : ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনার মেট্রো এলাকায় উন্নতমানের কসাইখানা নির্মাণ/স্থাপনের জন্য ২০২৪ সালের ৬ জুনে প্যাকেজ নং এলডিডিপি/ডব্লিউ-৮৫,৮৬,৮৭ অনুযায়ী তিনটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। প্রত্যেক কসাইখানার প্রাক্কলিত খরচ: ৯৯ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। মূল ডিপিপি অনুযায়ী তিনটি কসাইখানার ব্যয়: ২৪৯ কোটি টাকা। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী একই কাজের ব্যয়: ২৯৮ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা। ব্যয় নির্ধারণে ৪৯ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার পার্থক্য কোনও ব্যাখ্যার অনুপস্থিতি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে, এখানে পরিকল্পিতভাবে দর বাড়ানো হয়েছে।
ডাঃ গোলাম রব্বানী সরাসরি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। প্রকল্পের প্যাকেজকে তিনটি পৃথক দরপত্রে ভাগ করা হয়েছে যাতে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের ক্রয় কমিটির অনুমোদন এড়িয়ে যাওয়া যায়। এটি সরাসরি আর্থিক বিধি লংঘন এবং দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। এলডিডিপির পূর্ববর্তী কার্যক্রমও অনিয়মের দ্বারা দাগাকৃত। প্যাকেজ নং জি-৯৭, জি-৯৮, জি-৯৯ ও জি-১০০ মাধ্যমে মোট ২৫৪ কোটি ৬৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার মালামাল ক্রয় করা হয়। সেই সময়ও ডাঃ গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে ক্রয় কার্যক্রম পিপিআর লঙ্ঘন করে পরিচালিত হয়। প্রকল্পের অধীনে ৮-১০টি ক্রয় কার্যক্রমে আরও লঙ্ঘন লক্ষ্য করা গেছে। কর্মকর্তারা জানান, ডাঃ গোলাম রব্বানী প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিল রেখে নিজের প্রভাব ব্যবহার করে অনিয়ম চালিয়ে আসছেন। উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ডাঃ গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। তবুও সচিব, মন্ত্রী এবং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
প্রকল্পের সিনিয়র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, “প্রকল্পের সিটিসি ডাঃ গোলাম রব্বানীকে নাড়িয়ে অভিযোগ করলেও কার্যকর ফল পাওয়া যায় না।” এমনকি সচিব ও মন্ত্রীর নিকটও জি-৯৭ ও জি-১০০ প্যাকেজ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি সাপেক্ষে অভিযোগ জানানো হয়েছে, তবুও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
প্রকল্পের অধীনে নির্মিত বা স্থাপিত যন্ত্রপাতি অকেজো থাকার কারণে কোটি কোটি টাকা বেহাত হচ্ছে। কসাইখানা নির্মাণে অনিয়মের কারণে সরকারি অর্থের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে, সাধারণ মানুষ ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ডাঃ গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে এলডিডিপি প্রকল্পে যে ধারা গড়ে উঠেছে, তা শুধু আর্থিক অনিয়ম নয়; এটি প্রশাসনিক দুর্নীতি ও পরিকল্পিত লুটপাটের এক চিত্র। প্যাকেজ ভাঙা, দর বাড়ানো, পিপিআর লঙ্ঘন, কর্মকর্তাদের নীরবতা—সব মিলিয়ে এক গভীর দূর্বলতা তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক সহায়ক সংস্থা হিসেবে প্রকল্পে তদারকি করলেও কার্যকর মনিটরিং করতে ব্যর্থ। সরকারের মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উদাসীনতা প্রকল্পকে আরো দুর্নীতিপূর্ণ করে তুলেছে।
মন্তব্য