সব
পরিবর্তন: হরিজন পল্লীর জীবনে স্বাবলম্বিতার নতুন ঠিকানা
দীর্ঘদিন ধরেই সমাজের একটি অংশ থেকে গেছে সমাজের মূল স্রোতের বাইরে—অবহেলিত, উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। এই সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ হলো হরিজন সম্প্রদায়।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবেই যাদের আমরা চিনি, তারা প্রতিদিন শহরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে রাখে পরিচ্ছন্নতা, কিন্তু নিজেদের জীবন জড়িয়ে থাকে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা এবং সুযোগের অভাবে। এই দীর্ঘদিনের বঞ্চনার চক্র থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে জন্ম নেয় একটি ব্যতিক্রমধর্মী সামাজিক উদ্যোগ—“পরিবর্তন”।
‘পরিবর্তন’ মানেই সমাজে ইতিবাচক গতিশীলতা আনা
‘পরিবর্তন’ হলো একটি যুব-নেতৃত্বাধীন সামাজিক উদ্যোগ, যার মূল লক্ষ্য হলো হরিজন সম্প্রদায়ের কর্মক্ষম সদস্যদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলা। এই প্রকল্প শুধুমাত্র দান বা সাহায্যের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং আত্মসম্মান ও অধিকারকে ভিত্তি করে একটি স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা তৈরি করতে চায়।
প্রকল্পের সূচনা হয় চাইল্ড কেয়ার ও এল্ডার কেয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে। হরিজন সম্প্রদায়ের কর্মক্ষম নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কীভাবে শিশু ও প্রবীণদের যত্ন নেওয়া যায় নিরাপদ, মানবিক ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে। এর ফলে তারা শুধু পরিচ্ছন্নতাকর্মী নয়, বরং একজন প্রশিক্ষিত কেয়ারগিভার হিসেবে বিভিন্ন পরিবারে কাজ করার সুযোগ পায়। আজ বীণা, কানু, রতনরা কেয়ারগিভার হিসেবে কাজ করছে, অর্থ উপার্জন করছে, এবং তাদের সন্তানদের একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হস্তশিল্প: তাদের হাতে ছিল প্রতিভা, প্রয়োজন ছিল একটি প্ল্যাটফর্ম
প্রকল্পটি যখন আরও গভীরভাবে সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করতে শুরু করে, তখন তারা একটি বড় সত্য আবিষ্কার করে—এই মানুষগুলোর হাতে রয়েছে অসাধারণ হস্তশিল্প দক্ষতা। কেউ কাঠের কাজ জানেন, কেউ জানেন পাট দিয়ে গৃহসজ্জার সামগ্রী বানানো, কেউ দক্ষ কাপড়ের ব্যাগ বানাতে, আবার কেউ অসাধারণ নকশার কাজ জানেন। এই সুপ্ত প্রতিভাগুলোকে বাজারের সঙ্গে যুক্ত করাই হয়ে ওঠে ‘পরিবর্তন’-এর পরবর্তী লক্ষ্য।
‘পরিবর্তন’ একটি উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যেখানে এই পণ্যগুলো প্রদর্শন ও বিক্রয় করা হয়। শহরের ক্রেতারা এখন পছন্দ করে হরিজনদের তৈরি ব্যাগ, মেডিসিন বক্স, ম্যাট, শোপিস, কাঠের ফ্রেম। প্রতিটি পণ্যে লুকিয়ে থাকে তাদের সংগ্রামের গল্প, বাঁচার তাগিদ আর শিল্পমানস।
শিল্পী নয়, তারা পরিবর্তনের কারিগর
আজ গোপাল ও হরিদাস পাট দিয়ে তৈরি করছে শাড়ি ও গামছা, নির্মল ও নীলকমল কাঠের ফ্রেম, শোপিস, মেডিসিন বক্স তৈরি করছে, কমলা, ফুলবাসী ও রেবা কাপড়ের ব্যাগ ও নকশার কাজ করছে। একসময় যাদের জীবনে উৎসব মানেই ছিলো আরও একটি সাধারণ দিন, তারা এখন নিজেদের উপার্জনে পরিবারের ঈদ, পূজা বা নতুন বছর উদযাপন করছে সম্মানের সঙ্গে।
অভিযাত্রার অংশীদারিত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
‘পরিবর্তন’ আজ শুধু একটি প্রজেক্ট নয়, এটি একটি আন্দোলন—স্বাবলম্বিতার, সম্মানের, অধিকার প্রতিষ্ঠার। বর্তমানে এই প্রকল্পে রয়েছে একাধিক সংগঠনের সহযোগিতা—Spare প্রশিক্ষণ সহযোগী হিসেবে, Page Lasa হসপিটালিটি সহযোগী হিসেবে এবং The New Matribhandar লজিস্টিক পার্টনার হিসেবে কাজ করছে।
প্রতিষ্ঠাতারা মনে করেন, প্রকৃত পরিবর্তন আসে নিচু তলা থেকে—যখন একজন মা নিজের উপার্জনে সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়তে পারে, কিংবা একজন বাবা নিজের তৈরি পণ্য দেখে গর্ব অনুভব করে। এই প্রকল্প শুধু সহানুভূতির নয়, এটি সমানাধিকারের ভিত্তিতে একটি টেকসই সমাজ গঠনের চেষ্টা।
শেষ কথা
‘পরিবর্তন’ প্রমাণ করেছে যে সুযোগ দিলে, প্রতিটি মানুষই তাদের জীবনের চিত্র পাল্টে দিতে পারে। সমাজের অবহেলিত কোনা থেকে উঠে আসা এই মানুষগুলোর সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়—পরিবর্তন মানেই সম্ভাবনা। আজ তাদের গল্প শুধু অনুপ্রেরণার নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের এক অনবদ্য নজির।
মন্তব্য