সব
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অন্যতম প্রয়োজনীয় সার নিয়ে যুগযুগ ধরে চলছে তুঘলিকান্ড। কৃষকের চাহিদাকে পুঁজি করে প্রতিবছরই বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) বিদেশ থেকে সার আমদানী ও পরিবহণকালে হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। এসব লুটেরাদের লাগাম টানার পরিবর্তে বিএডিসি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ নিজেই ‘রক্ষক সেজে ভক্ষকের ভূমিকায়’ অবতীর্ণ হয়েছেন।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছর শাসনামলে সার সেক্টরে প্রথম কালো থাবাটি দেয় তৎকালীন সরকারের এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা কামরুল আশরাফ খান পোটন। কয়েক বছরের ব্যবধানে সরকারি সংস্থা বিসিআইসি ও বিএডিসি’র আমদানী করা সার পরিবহন না করে কালো বাজারে বিক্রি করে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে এমপি পোটনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ আছে, ওই লুটপাটের টাকার কমিশন হিসেবে সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী ছাড়াও বিসিআইসি-বিএডিসি চেয়ারম্যান ও উচ্চ পদস্থরা শত’ শত’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই সময়কালে দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমে সারাবছরই শিরোনাম হয়ে থাকতো আলোচিত মেসার্স পোটন ট্রেডার্স। একপর্যায়ে বিসিআইসির ৪৮০ কোটি টাকার সার গায়েবের খবর আলোচনায় আসলে ওই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে সংস্থাটি। এতো বড় কেলেংকারির খবরটি ‘টক অব দ্যা কান্ট্রিতে’ পরিণত হলেও কানে নেয়নি বিএডিসি।
এমনকি, বিসিআইসির কালো তালিকাভুক্ত মেসার্স পোটন ট্রেডার্সকে বিএডিসির সার পরিবহণের টেন্ডারে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়ে নজির সৃষ্টি করা হয়। ওই সময় বিষয়টিকে বিএডিসির লুটপাটের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বলেই বিবেচিত হয়। সংস্থাটিতে ‘কোণঠাসা অবস্থায়’ থাকা কর্মকর্তারাদের অভ্যন্তরীণ আলোচনা শুরু হলে বাইরে ফাঁস হওয়ার ভয়ে নিজেদের নিরাপদে রাখতে মেসার্স পোটন ট্রেডার্সককে ‘দায়সারাভাবে’ কালো তালিকাভুক্ত করে বিএডিসি। তারপরও তাদের কাছে থাকা ১ হাজার ২৫০ কেটি টাকার সার আদায় করতে চিঠি-চালাচালি ব্যাতিত খুব বড় ধরণের অ্যাকশান নিতে দেখা যায়নি বিএডিসির বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সদস্য পরিচালক (সার) আব্দুস সামাদসহ উদ্ধর্তন কর্মকর্তারাদের। ফলে আরও বেশ কয়েকটি পরিবহণ ঠিকাদার একই পথে হাঁটতে শুরু করে।
বিএডিসি সূত্রমতে, চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ তৎকালীন কৃষি মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠভাজনের আসনে অধিষ্ঠ হয়। এরপর একক আধিপত্য বিস্তার করে প্রয়োজন নির্ধারণ না করেই উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে সার আমদানী, অদক্ষ পরিবহণ ঠিকাদার অন্তর্ভুক্তি, অদক্ষ ঠিকাদারদের পরিবহণ কাজ পাইয়ে দিয়ে এবং বিল ছাড়ের সময় কমিশন আদায় এবং কর্মকর্তাদের পোস্টিং বাণিজ্য করে শত’ শত’ কোটি টাকা আদায় করেছেন চেয়াম্যান ও তার অনুগত কর্মকর্তারা। যার প্রভাব পড়েছে সার পরিবহণ সেক্টরে। কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তাদের চাহিদামাফিক ঘুষ দিয়ে কাজ নিয়ে সরকারি সার গুদামে পৌঁছে না দিয়ে কালো বাজারে বিক্রি করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। এমনকি, আলোচিত পোটন ট্রেডার্স বিসিআইসির ৪৮০ কোটি এবং বিএডিসির ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার সার হজমের পরেও তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে মোটেও সতর্ক হয়নি। বরং পরেও সক্ষমতা যাচাই না করেই স্বদেশ শিপিং এন্ড লজিস্টিক, এজি এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স প্যাসেফিক কনজ্যুমার গুডস, মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিংসহ ৫-৬টি অদক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্তি করে। অভিযোগ আছে, এসব প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে।
বিএডিসি সূত্রে আরও জানা গেছে, বড় অংকের ঘুষের বিনিময়ে অন্তর্ভুক্ত করা অদক্ষ ঠিকাদার পরিবহণ ঠিকাদারদের দরপত্রের শিডিউলের নিয়ম বহির্ভুতভাবে ব্যাংক গ্যারান্টি (পিজি) না দিয়েই কাজ পাইয়ে দিয়েছেন বিএডিসি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সদস্য পরিচালক (সার) আব্দুস সামাদসহ উদ্ধর্তন কর্মকর্তারা। এরপর ওইসব ঠিকাদারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানী করা হাজার হাজার কোটি টাকার সরকারি সার। তবে অধিকাংশ সারই বিএডিসি গুদামে পৌঁছে না দিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করেছে ওইসব ঠিকাদার।
সর্বশেষ তথ্যঅনুযায়ী, পরিবহণ ঠিকাদার মেসার্স প্যাসেফিক কনজ্যুমার গুডস’র কাছে ৮০ হাজার মেট্রিকটনের বেশি এমওপি, স্বদেশ শিপিং এন্ড লজিস্টিকের কাছে প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিকটন এমওপি এবং সাড়ে ১১ হাজার মেট্রিকটন টিএসপি, মেসার্স এজি এন্টারপ্রাইজের কাছে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিকটন টিএসপি, মেসার্স কুষ্টিয়া ট্রেডিংয়ের কাছে প্রায় ২৫০০ মেট্রিকটন টিএসপি (২০২১-২০২২ অর্থবছরে আমদানী), মেসার্স বঙ্গ ট্রেডার্সের কাছে প্রায় ৩৫০০ মেট্রিকটন ডিএপি সার পরিবহনাধীন অবস্থায় আছে। সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে গুদাম করে কিছু সারের দেখা মেলে। যদিও ওই সারের পরিমাণ এবং মান নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। তারপরও ওইসব ঠিকাদারদের কাছ থেকে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার সার যেকোন মূল্যে বুঝে নেওয়ার প্রতি আগ্রহ দেখা যায় না বিএডিসির। বরং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ আমদানী করা সার নিজেদের গুদামে বুঝে নেওয়ার চেয়ে ফের আমদানী ও দুর্নীতিতে যুক্ত হয়ে সরকারি এ সংস্থাটিকে কার্যত ভঙ্কুর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তিত করেছেন।
বিএডিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম হঠাৎ করে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। সেসময় দেশে সারের চাহিদা বিবেচনা না করেই জি টু জি চুক্তির অধীনে কানাডা থেকে ৮ লাখ মেট্রিকটন এমওপি সার আমদানীর সিদ্ধান্ত নেয় বিএডিসি। ওই সারের প্রতি মেট্রিকটনের ক্রয়মূল্য ছিলো ৬৫০ থেকে ৬৮০ ডলার। ২০২৩ সালে আগস্ট মাসে দেশে পৌঁছানো উচ্চমূল্যের সেই সারের মধ্যে আনুমানিক এখনও দুই লাখ মেট্রিকটন পরিবহণ ঠিকাদারদের কাছে হদিসহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অথচ, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ওই সারের দাম প্রতিমেট্রিকটন ৩০০ থেকে ৩২৫ ডলার। এতে অব্যবহৃত প্রায় ২ লাখ মেট্রিকটনেই সরকারি গচ্চা কমপক্ষে ৭২০ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, ওই সার আমদানীর ক্ষেত্রেও বিএডিসির বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ ও তৎকালীন সদস্য পরিচালক (সার) আব্দুস সামাদ বিরাট অংকের কমিশন বাণিজ্য করেছেন। এমনকি, উচ্চমূল্যে আমদানীকরা ওই সার ২০২৩ সালের আগস্টে দেশে পৌঁছালেও এখনো প্রায় দুই লাখ মেট্রিকটন বিএডিসি গুদামে পৌঁছায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ওই সারের অধিকাংশই সংশ্লিষ্ট পরিবহণ ঠিকাদার কালো বাজারে বিক্রি করেছেন।
এছাড়াও এই কাজে যুক্ত পরিবহণ ঠিকাদারদের নিয়োগের সময় দরপত্রের শিডিউল অনুযায়ী ব্যাংক গ্যারান্টিও (পিজি) নেওয়া হয়নি। তাদের এইসব অনিয়মের কারণে বিএডিসির চট্টগ্রাম ও খুলনা দপ্তরে কয়েকটি বিল আটকে দেয় কর্মকর্তারা। সেখানেও বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ হস্তক্ষেপ করে কয়েকটি বিল ছাড় করানোর ব্যবস্থা করেছেন বলেও জানা গেছে। দেশের বর্তমান সংকটকালীন সময়েও আসন্ন মৌসুমে কৃষকের চাহিদা মোতাবেক সার সরবরাহের জন্য তুলনামূলক প্রস্তুতির তোড়জোড় নেই বিএডিসির। বিষয়টিকে এখনই গুরুত্ব না দিলে আসন্ন বোরো মৌসুমে সার নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
এ সকল বিষয়ে জানতে বিএডিসি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ’র মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য