প্রকাশের সময়: বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ । ৬:১৩ অপরাহ্ণ প্রিন্ট এর তারিখঃ বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য খাতে ১৫ কোটি টাকা লুটপাট

সেলিম মিয়া, স্টাফ রিপোর্টার।।

দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন (মসিক)। কাগুজে প্রকল্প দেখিয়ে নয়ছয় করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

একাধিক সূত্রে জানা যায়, মসিকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত বছরের পাঁচ আগস্টের পর সাত-আট মাস চুপ থাকলেও এ বছরের মে মাস থেকে তারা আগের চরিত্রে ফিরে গেছেন। পিছিয়ে নেই আলোচিত স্বাস্থ্য বিভাগ। এ বিভাগে গুরু-শিষ্যের অনিয়ম-দুর্নীতি অতিতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও রহস্যজনক কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথ (এইচকে দেবনাথ) ও স্বাস্থ্য সহকারী সাইফুল ইসলাম (সাজু)। এদের জ্বালায় অতিষ্ঠ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকরা। গুরু-শিষ্য মসিক থেকে ছয় বছরে ১৫ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জানা যায়, মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথ মসিকের স্বাস্থ্য বিভাগে লাগামহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি নানা বিষয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। শিষ্য স্বাস্থ্য সহকারী সাইফুল ইসলাম তাকে সহযোগিতা করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র (৯১২০৭৬৩৯০০) ও চাকরির ব্যক্তিগত নথিতে হরে কৃঞ্চ দেবনাথ নাম থাকলেও নিজের নামের একাংশ পাল্টে এইচকে দেবনাথ রেখেছেন। অফিসের সিল, প্যাড, নেমপ্লেট, বিল-ভাউচার, চিঠি আদান-প্রদান ও মসিকের হিসাব বিভাগ থেকে বানানো নামে চেক গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে ময়মনসিংহ পৌরসভায় (সিটি করপোরেশন) যোগদানের পর থেকেই তিনি নাম জালিয়াতি করে যাচ্ছেন। বিষয়টি জালিয়াতি বলে উল্লেখ করেছেন ট্রেজারী কর্মকর্তারা।

সূত্র জানায়, পাসপোর্টের ক্ষেত্রেও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথ। ভুল তথ্য দিয়ে অবৈধ পন্থায় ২০২৩ সালের মার্চ মাসে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট নেন। তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলীর স্বাক্ষর করা ০৫-০৩-২০২৩ তারিখের মসিক/প্রশা/সাধা/২৩/৩৮৩ স্মারকে পাসপোর্ট অফিসে এনওসি পাঠানো হয়। এতে তিনি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পরিচয় দেন। ওই সময় তিনি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ চলতি দায়িত্বে থাকলেও এনওসিতে তা উল্লেখ করেননি। তা ছাড়া ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ ও ঢাকার বাসার ঠিকানা না দিয়ে পাসপোর্টের আবেদনে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ঠিকানা ব্যবহার করেন। পুরো প্রক্রিয়ায় তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন বলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।

জানা যায়, গুরু-শিষ্যের কাছে মসিকের স্বাস্থ্য বিভাগ জিম্মি হয়ে পড়েছে। সম্মানি ও ‘হিস্যা’ নিয়ে কর্মচারী, স্বেচ্ছাসেবক ও গণমাধ্যকর্মীদের সঙ্গে বিরোধ ও তর্কবিতর্ক হয়। বিভিন্ন টিকা ও ক্যাপসুল খাওয়ানো কর্মসূচিকে পুঁজি করে সরকারি ও মসিকের তহবিল থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। টিকাদান কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মানি মেরে দিয়েও গুরু-শিষ্য আলোচনায়। সূত্র মতে, মসিকের স্বাস্থ্য খাতে লুটপাট হওয়া ১৫ কোটি টাকার মধ্যে করোনার আড়াই বছরে আট কোটি, গত ছয় বছরের বিভিন্ন সময়ে চার কোটি, নগর মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে তিন কোটি টাকা লুটপাট করা হয়। লুটপাটের টাকায় ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথ কিশোরগঞ্জে জমি ও ঢাকার মোহাম্মদপুরে ফ্ল্যাট কেনা ছাড়াও নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। স্বাস্থ্য সহকারী সাইফুল ইসলাম (সাজু) ময়মনসিংহ নগরীতে জমি ও ফ্ল্যাট কেনাসহ গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মাদারগঞ্জে বিপুল জমি কিনেছেন।

সূত্র জানায়, ২০২০ সালে করোনা শুরু হওয়ার পরই টাকা লুটপাট করতে মাঠে নামেন আলোচিত গুরু-শিষ্য। তারা মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ভুল বুঝিয়ে কোটি কোটি টাকার সুরক্ষা সামগ্রী কিনতে থাকেন।

করোনার সময় পর্যায়ক্রমে পাঁচ কোটি টাকার পিপিই, মাক্স, স্যানিটাইজারসহ অন্যান্য পণ্য ক্রয় দেখানো হয়। সাইফুল ইসলাম (সাজু) পাঁচ কোটি টাকার মালামাল কিনে একাই তিন কোটি আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া গত ছয় বছরে বিভিন্ন ফাইল ও জন্মনিবন্ধন থেকে ‘ধুরন্ধর’ সাজু আরো দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। একই সময় মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথ করোনার টিকা প্রদান কার্যক্রম, বিভিন্ন টিকা ও ক্যাপসুল খাওয়ানো কর্মসূচি থেকে চার কোটি এবং নগর মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র খাত থেকে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

আলোচিত গুরু-শিষ্য, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ও তাদের প্রতিনিধির নামে গত ছয় বছরে হিসাব বিভাগ থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকার চেক ইস্যু হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। তার মধ্যে সাইফুল ইসলামের একার নামেই ইস্যু হয়েছে চার কোটি টাকার চেক। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও গুরুসহ তাদের লোকজনের নামে বাকি টাকার চেক ইস্যু হয়। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে কয়েকজন উচ্চমান সহকারী ও নিম্নমান সহকারী থাকলেও কাউকেই স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় না। টাকা হাতানোর গোমর ফাঁস হওয়ার ভয়ে শিষ্য সাইফুল ইসলাম একাই সব কিছু সামলান। বছর খানেক আগে এ নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলে নিম্নমান সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক মো. ওয়ালিউল ইসলামকে স্বাস্থ্য বিভাগে বদলি করা হয়। ‘ধুরন্ধর’ গুরু-শিষ্যের চক্রান্তে টিকতে না পেরে তিনি অন্য শাখায় ফিরে যান।

জানা যায়, মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথের টাকা হাতানোর উৎস একটি মাতৃসদন ও তিনটি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। বাঘমারায় নগর মাতৃসদন, খাগডহর, গোলকীবাড়ি ও শম্ভুগঞ্জে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চারটি কেন্দ্রে সাতজন ডাক্তার, ১২ জন প্যারামেডিক ও ৮১ জন স্টাফ থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। চারজন ডাক্তার, চারজন প্যারামেডিক ও ৫০ জন স্টাফ দিয়ে চলছে চারটি কেন্দ্র। এ খাতে বিল-ভাউচার করে প্রতি মাসে ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়। মাসে গড়ে ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র মতে, এডিবির অর্থায়নে ‘আরবান হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারী প্রজেক্ট-২’ ২০২২ সালের জুন মাসে দুই বছর মেয়াদি প্রকল্প শুরু করে। ২০২৪ সালের জুন মাস থেকে মন্ত্রণালয় ও মসিকের অর্থায়নে প্রকল্পটি চালু রাখা হয়েছে। এর মেয়াদ চলতি ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। মন্ত্রণালয়, মসিক ও পিএসটিসি এনজিও টাকার জোগান দেওয়ার কথা।

সূত্র জানায়, পপুলেশন সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিএসটিসি) এনজিও কেন্দ্রগুলো দেখভাল করার কথা। মসিকের মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথ প্রকল্পের প্রোগ্রাম অফিসার ও পিএসটিসি’র ইকবাল হোসেন প্রজেক্ট ম্যানেজার। সব কিছুই মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথের নিয়ন্ত্রণে। তাকে ছাড়া হয় না নিয়োগ ও কেনাকাটা। চারটি কেন্দ্রে নিয়োগ করা কর্মীদের কাছ থেকেও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র মতে, মাতৃসদন ও নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র নগরবাসীর কোনো কাজে আসছে না। কোনো নাগরিক চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসা পেয়েছেন এমন নজির নেই। কেন্দ্রের চিকিৎসা সরঞ্জাম, পরীক্ষার সামগ্রী ও অন্যান্য মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রেও মোটা অঙ্ক হাতিয়ে নেন মেডিকেল অফিসার ডা. হরে কৃঞ্চ দেবনাথ। ব্যহত হচ্ছে ভিটামিন এ প্লাস, কৃমি নাশক ও টাইফয়েডের মতো জীবনরক্ষাকারী টিকাদান কর্মসূচি। নয়ছয় করেন এ সব খাতের অধিকাংশ টাকা। তার বিরুদ্ধে সম্মানি আত্মসাতের অভিযোগে কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকরা বিক্ষোভ করেন।

গুরু-শিষ্যের অভিযোগ সম্পর্কে মসিকের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুমনা আল মজীদ গতকাল রোববার রাতে একটি দৈনিক পত্রিকাকে বলেন, ‘অভিযোগ তদন্ত করে দোষীদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কোনো অবস্থাতেই তারা ছাড় পাবেন না।

অপরদিকে মসিকের কঞ্চন নন্দি, লাইসেন্স পরিদর্শক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সহ বেশ কয়েকজন এর বিরুদ্ধে ব্যাপক ঘুষ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

প্রকাশক ও সম্পাদকঃ মোঃ মাইন উদ্দিন উজ্জ্বল, প্রধান সম্পাদকঃ শিবলী সাদিক খান, নির্বাহী সম্পাদকঃ জহির রায়হান,  বার্তাকক্ষঃ 75bdnews@gmail.com

প্রিন্ট করুন