গত সরকারের আমল থেকেই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি) ঘিরে নানা অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এসেছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং অধিদপ্তরের সাবেক ক্যাশিয়ার—ডেস্ক–১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান আলী। ধারাবাহিকভাবে বদলি–পদোন্নতির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার, ঘুষ–দুর্নীতির মাধ্যমে পদায়ন বাণিজ্য—সব অভিযোগেই তার নাম ঘুরে ফিরে আসে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও পুরোনো প্রভাববলয়ের মাধ্যমে গড়া ‘সিন্ডিকেট’ আগের মতোই সক্রিয় রয়েছে বলেই জানা যায়।
অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সর্বশেষ চারজন প্রধান প্রকৌশলীই বিভিন্ন সময় শাহজাহান আলীর চাপ–প্রভাব এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট লবির ইন্দনে নিজেদের পদে স্থায়ীভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারেননি। তার মনমতো সিদ্ধান্ত না নিলে প্রধান প্রকৌশলীদের বদলির ব্যবস্থা করা হতো বলেই ধারণা করা হয়। সাম্প্রতিক এক প্রজ্ঞাপনে তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলীর বদলির আদেশ জারি হলেও শাহজাহান আলীর ‘ইঙ্গিত’ না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে মেহেরপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রায় একমাস ধরে বদলিকৃত কর্মস্থল যশোরে যোগদান করতে না পেরে ‘ভাসমান অবস্থায়’ রয়েছেন। সূত্র বলছে—বেশি অর্থের বিনিময়ে গুরুত্বপূর্ণ জেলায় দশজন নির্বাহী প্রকৌশলীর পদায়নের একটি তালিকাও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
একই সঙ্গে কুড়িগ্রাম শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে দায়িত্ব পালনকালে শাহজাহান আলীর বিরুদ্ধে ওঠে ভয়াবহ ঘুষ–দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। তদন্তে বেরিয়ে আসে—চূড়ান্ত বিল প্রদানের আগে বাধ্যতামূলক ৫ শতাংশ ঘুষ, উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের এলাকায় দায়িত্ব বণ্টনে ১ শতাংশ ‘উৎকোচ’, এবং কিছু স্বজনপ্রীতি–ঘনিষ্ঠ কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠানের নামে দরপত্র ‘কিনে’ বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছে ৫ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে বিক্রি করার মতো গুরুতর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে আসবাবপত্র সরবরাহ প্রকল্পে আহ্বান করা ৩৯টি দরপত্রের মধ্যে ২৬টি এককভাবে তার মনোনীত ঠিকাদারকে দেওয়ারও প্রমাণ মিলেছে। অভিযোগ রয়েছে—প্রতিবাদ জানানোর জেরে একাধিক ঠিকাদারকে তিনি দলীয় ক্যাডার ও সুবিধাবাদী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হয়রানি করেছেন এবং সাধারণ ঠিকাদারদের দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ সীমিত করেছেন।
অভ্যন্তরীণ কর্মচারীরা জানিয়েছেন—হিসাবরক্ষক ও অফিস সহকারীদের মাধ্যমে নিয়মিত ঘুষ সংগ্রহ করা হতো। ঘুষ না নেওয়ার কারণে সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত কিছু উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। অনিয়ম থেকে অর্জিত অর্থে রংপুরে ক্লিনিক ব্যবসা, ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট এবং গ্রামের বাড়িতে প্রচুর পরিমাণ জমি কেনার অভিযোগও উঠেছে। ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পরপরই তিনি দ্রুত টাঙ্গাইল জেলায় বদলি নিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন বলেও জানা যায়।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান আলীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদাররাও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে রংপুর বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তারেক আনোয়ার জাহেদী বলেন—“কেউ অনিয়ম করে থাকলে পার পাওয়ার সুযোগ নেই; দশ বছর পর হলেও তা শনাক্ত করা সম্ভব।” তিনি অভিযোগগুলোর বিষয় তদন্ত করার আশ্বাস দেন।
বিশাল অঙ্কের ঘুষ–বাণিজ্য, প্রভাবশালী লবির নিয়ন্ত্রণ এবং ধারাবাহিক অনিয়মের মুখে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থ আজ প্রশ্নবিদ্ধ। স্থানীয় ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্টরা দ্রুত তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

সেলিম মিয়া, স্টাফ রিপোর্টার।।