‘বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধার জুতোই নেই। তবু মোজাও কিনি। মোজা দিই। অন্তত নিজেকে তো ভোলানো যায়—আমার ছেলেরা এই শীতে জুতো-মোজা পরে যুদ্ধ করছে।
’ ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিচারণা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বরের স্মৃতিচারণায় তিনি তুলে ধরেছেন সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাস্তবতা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে শহীদ শাফী ইমাম রুমীর মা জাহানারা ইমাম নিয়মিত গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। শীতের শুরুতে তিনি শীতবস্ত্রও কিনে পাঠাতেন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। বিজয়ের মাত্র তিন দিন আগে তার বড় ছেলে রুমী শহীদ হন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয় বাঙালি জাতি। তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালিদের দীর্ঘদিনের স্বাধিকারের আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি পায় ডিসেম্বর মাসে। বিশ্বের বুকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় বাংলাদেশ নামের এক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নতুন ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়ে বাঙালি। শোষণ-বঞ্চনা চলে ২৩ বছর। ভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু করে ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন আর সত্তরের নির্বাচনের পথ ধরে চলে আসে ঐতিহাসিক একাত্তর। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী বাঙালি জনগণের ওপর আক্রমণ শুরু করে। তাদের পরিকল্পিত গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বহু প্রাণ ও নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি দেখা পায় তার পরম আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে পাকিস্তানি সেনারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লেখক, শিক্ষক, শিল্পীসহ জাতির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের অনেককে। ডিসেম্বর তাই বাঙালি জাতির জন্য যুগপৎ অশ্রু ও উত্সবের মাস।
এবার বিজয়ের মাস উদযাপিত হচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। আবারও বহু প্রাণের বিনিময়ে প্রায় ১৬ বছরের একটানা কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়। এবার তাই কিছুটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে উদযাপিত হতে যাচ্ছে বিজয়ের মাস ও বিজয় দিবস। বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর পালিত হবে বিজয় দিবস।
বিজয় দিবস সামনে রেখে এবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিটি জেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান এবং চারু, কারু ও স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত শিল্পপণ্য নিয়ে বিজয়মেলা আয়োজন করবে বলে জানা গেছে।
মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন নিয়ে অনিশ্চয়তা : বেশ কয়েক বছর ধরে ১ ডিসেম্বর কয়েকটি রাজনৈতিক দল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করে আসছে। তবে এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দিবসটি পালন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
১ ডিসেম্বরের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে “সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১” ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবছর এদিন সকালে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তন বেদিতে সমবেত হয়ে দিবসটি উদযাপন করেন। তবে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবার দিবসটি উদযাপন করবে না বলে জানা গেছে।