গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রভাবশালী প্রকৌশলীদের ঢাকা ছাড়তে হয় না, এ যেন এক অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর ঘুরে ফিরে ঢাকায় । গেল ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে দেশের অন্যতম বিতর্কিত এ অধিদপ্তরের চিত্র কিছুটা পাল্টাবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও মূলত দেখা গেছে একই ধারাবাহিকতা।
অভিযোগ রয়েছে , প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারকে ঘিরে কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট টেন্ডার ও পোস্টিং বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামানোর যে মিশন শুরু করেছিলেন; তা এখনও অব্যাহত আছে। গেল ১ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের স্বাক্ষর করা অফিস আদেশে দেখা যায় নির্বাহী প্রকৌশলী (ই/এম) সমীরণ মিস্ত্রীকে গণপূর্ত ( ই/এম, বিভাগ- ৭ ) ঢাকা থেকে গণপূর্ত পিএন্ডডি বিভাগ – ১ ঢাকায় পদায়ন করা হয়। একই আদেশে নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনকে পিএন্ডডি বিভাগ – ১ ঢাকা থেকে ই/এম বিভাগ -৭ ঢাকায় পদায়ন করা হয়।
একদিন পরে ২ সেপ্টেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের স্বাক্ষর করা অন্য একটি অফিস আদেশে দেখা যায়, প্রধান প্রকৌশলী স্টাফ অফিসার মাহফুজুল আলমকে ( নির্বাহী প্রকৌশলী, রিজার্ভ ) ঢাকার গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে ঢাকার প্রকল্প বিভাগ -৫ এ ; মেহেরপুর থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী শম্ভু রাম পালকে টাঙ্গাইলে; নির্বাহী প্রকৌশলী আজমুল হককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গণপূর্ত বিভাগ থেকে অধিদপ্তরে নির্বাহী প্রকৌশলী, রিজার্ভ, প্রধান প্রকৌশলী স্টাফ অফিসার ; নির্বাহী প্রকৌশলী আ. ন. ম . মাজহারুল ইসলামকে ঢাকার প্রকল্প বিভাগ-৫ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গণপূর্তে; নির্বাহী প্রকৌশলী এস. এম. তৌহিদুল ইসলামকে টাঙ্গাইল থেকে মেহেরপুরে বদলী করা হয়।
চলতি সেপ্টেম্বরে এসব বদলীর মধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সমীরণ মিস্ত্রীকে ঘিরে। অভিযোগ আছে, দীর্ঘ সময় ঢাকায় থাকা প্রকৌশলীদের নিয়ে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন এই প্রকৌশলী। এমনকি কার কোথায় পোস্টিং হবে তাও নির্ধারণ করেন সমীরণ।
সমীরণ মিস্ত্রী শেরে বাংলা নগর (ইএম) ডিভিশনে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করে মেরামত খাতে কমপক্ষে ৮০ কোটি টাকা খরচ করেছেন। যার বেশিরভাগই কাজ না করে নিজের বিশ্বস্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিল-ভাউচার করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সংসদ সচিবালয়ে আসা মেরামতের টাকার একটি বড় অংশ সমীরণের মাধ্যমে খরচ হয়েছে। সেখানে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এতকিছুর পরও সমীরণ মিস্ত্রীকে সমীহ করে ঢাকাতেই রাখলেন প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খোদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এই বদলীকে ‘ পেইড পোস্টিং’ হিসেবে দেখছেন যার আনুমানিক খরচ ২ থেকে ৩ কোটি টাকা বলে জানায় সূত্রটি। কেউ কেউ মনে করছেন দ্রুত নিজের পদ হারাতে পারেন প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার; এমন আশঙ্কা থেকেই যা পারছেন আয় করে নিচ্ছেন।
আলোচিত পেইড পোস্টিং বিষয়ে জানতে নির্বাহী প্রকৌশলী সমীরণ মিস্ত্রীকে ফোন করা হলেও তার কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারকেও ফোন করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, মোহাম্মদ শামীম আখতারের অনিয়মরে বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে তদন্ত করে কমিটিকে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ২ সেপ্টেস্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শেখ নূর মোহাম্মাদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অডিট অনুবিভাগ) শাহনাজ সামাদকে আহ্বায়ক, উপসচিব (বাজেট অধিশাখা-৪) মো. মাহবুবুর রহমান সদস্য সচিব ও যুগ্মসচিব (উন্নয়ন অধিশাখা-১৪) মো. জহিরুল ইসলাম খানকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে উল্লিখিত অভিযোগগুলো তদন্তপূর্বক সুস্পষ্ট মতামতসহ একটি প্রতিবেদন সচিব, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বরাবর দাখিল করতে বলা হয়েছে।
চলতি বছরের ১৩ জুলাই গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের স্বাক্ষর করা পৃথক দুটি অফিস আদেশে দেখা যায়, চাকরি জীবনে সহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন ডিভিশনে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেছেন এমন প্রভাবশালী নির্বাহী প্রকৌশলীদের ঢাকার মধ্যে অদল বদল করা হয়েছে। জুলাই মাসে শেরবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ–৩–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাসুদ রানাকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ–৪; ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ–১–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুল ইসলামকে শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ–৩; ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ–৪–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুজ্জামান চুন্নুকে ঢাকা গণপূর্ত বিভাগ–১ এবং শেরেবাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ–২–এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসানকে মহাখালী গণপূর্ত বিভাগে বদলি করা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারে প্রভাবশালী মন্ত্রী, সচিব ও রাজনীতিবিদদের কোটায় এ পাঁচ প্রকৌশলীর সিন্ডিকেট করে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নামে বেনামে অঢেল সম্পদের অভিযোগ থাকার পরেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।