অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি-দাওয়ার যেন শেষ নেই। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে জানানো হচ্ছে নানা ধরনের দাবি। দাবি দাওয়া নিয়ে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতর ও বাইরে ঘেরাও, অবস্থানসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কর্মসূচি চলছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কেও। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেটিজেনরা প্রতিবাদ মুখোর হয়ে উঠেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, এতদিন তাদের এতো ক্ষোভ কোথায় ছিল? দীর্ঘ ১৬ বছর অসংখ্য অন্যায়, অনিয়ম, বঞ্চনা নিয়ে টু শব্দটি করেনি কেউ। কিন্তু দশ সহস্রাধিক হতাহতের রক্তের বিনিময়ে যখন দেশে পরিবর্তন এলো, তখন সরকারী বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নানারকম দাবি-দাওয়া নিয়ে। সরকারকে স্থিতিশীল হওয়ার সময় পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে না।
মেট্রো রেল চলার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু কর্মচারীরা তাদের দাবি-দাওয়া পূরণ না হলে চাকরিতে যোগ দেবে না। একই অবস্থা রেল যোগাযোগেও। কর্মচারীদের দাবি দাওয়া পূরণ না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গভাবে রেল চলাচল চালু করা যাচ্ছে না। সচিবালয়ে ৯ দফা দাবি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন সব মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবিগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে সোচ্চার আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়। এদিকে বিসিএস ১৩তম থেকে ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদোন্নতির দাবি জানিয়ে আবেদন করেছেন। ওই স্মারক লিপিতে তারা ২০০২ সালের প্রণীত সরকারের উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালার বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি করেন।
বেতন বৈষম্য রোধসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কয়েক দিন ধরেই অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন বাংলাদেশ গ্রাম-পুলিশের সদস্যরা। পেনশন চালুকরণ, পদ সৃজন, পদোন্নতি, সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি ও আউটসোর্সিং-ডেইলি বেসিসের চাকরি সরকারিকরণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অপরদিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের রাজস্ব খাতের স্থায়ী কর্মকর্তারা পদোন্নতির দাবি জানিয়েছেন। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে তারা এমন দাবি জানান।
দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অবদান সত্ত্বেও বিসিএস খাদ্য (কারিগরি) ক্যাডার কর্মকর্তাগণ আভ্যন্তরীণ নানা ধরণের বৈষম্য ও বিমাতাসুলভ আচরণের সম্মুখীন হচ্ছেন। এসব বৈষম্য দূর করতে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন খাদ্য কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদপ্তরের অধীনে ‘ইউনিয়ন প্রকল্প’র জনবল রাজস্ব বাজেটের আওতায় আনার দাবি নিয়ে এসেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন হলে আমাদের সমস্যা কেটে যাবে। সেজন্য আমরা অবস্থান নিয়েছি। মিরপুরে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদত্যাগ ও অনিয়মের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্য অবসানের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাডেমিকস। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বেতারের মূল ফটকের সামনে মানববন্ধন করেছেন বাংলাদেশ বেতারের সর্বস্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, নিজস্ব শিল্পী এবং কলাকুশলীরা। চাকরিতে পদোন্নতিবঞ্চনাসহ বিভিন্ন বৈষম্য নিরসনের দাবি জানিয়েছেন তারা। বিশ দফা দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চুক্তিভিত্তিক কেবিন ক্রুরা। বাংলাদেশ বিমান কেবিন ক্রু ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অন্দোলনরতরা অনশন করেন। দাবি পূরণ না হলে কর্মবিরতির হুমকি দেন ক্রুরা। ফলে বিঘ্নিত হতে পারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ডমেস্টেক এবং ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের সময়সূচি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২’ বাস্তবায়ন, ফিল্ড পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পদ আপগ্রেডেশনসহ নানা বিষয়ে সংস্কার চেয়ে মানববন্ধন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। রাজধানীর মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের সামনে দাবি আদায়ে মানববন্ধন করেন তারা।
দাবি দাওয়ার ভিড়ে প্রেসক্লাবের সামনে জায়গা না পেয়ে তৎকালীন বিডিআর থেকে চাকরিচ্যুত সদস্যদের একটি দল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বলেন, বিদ্রোহের কোনো ঘটনার সঙ্গেই তাঁরা জড়িত ছিলেন না। বিনা কারণে তাঁদের চাকরিচ্যুত করার পাশাপাশি অন্য বাহিনীতে যোগ দিতে গেলেও তাঁদের বাদ দেওয়া হয়। এখন চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে তাঁরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেবেন। অটোরিকশা চালকরা সায়েদাবাদের জনপথ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। আন্দোলনকারীরা বলছেন, দৈনিক এক হাজার ২৫০ টাকা জমা দিতে হয় চালকদের। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দৈনিক জমা ৯০০ টাকা। মালিকরা ৩৫০ টাকা বেশি নেন। তাদের দাবি, সরকার নির্ধারিত টাকা জমা নেবেন মালিকরা। মহাখালী রেলগেট সংলগ্ন বৃটিশ টোবাকো কর্মচারীরা বিক্ষোভ করছেন। তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে এই আন্দোলন চলছে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের এই পদগুলো রাজস্ব খাতে নেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন করে। বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষক সমিতি জাতীয়করণের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। অবস্থান নেয় বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারি কর্মকর্তারা। তারা তাদের ব্যানারে তাদের চাকরি স্থায়ী করার দাবি জানিয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্লোগানে মুখরিত করে তোলে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণ।
এক সারিতে বসা সাদা অ্যাপ্রোন পরা নার্সরা। তাদের দাবি বেতন বৈষম্য দূর করা। আবার এক পাশে দাঁড়িয়ে নীল রঙের নার্সরা দাবি তুলছেন, ভুয়া নার্স বাতিল করতে হবে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ক্ষতিগ্রস্ত ঠিকাদার সমন্বয় কমিটি কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ ও দুনীতি বন্ধ করাসহ ১০ দফা দাবি জানিয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে এই দাবি বাস্তবায়ন না হলে সড়ক ভবন ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি দেন। ইডকলের ১০৬ জন কর্মচারীর চাকরি পুনর্বহাল দাবিতে গতকাল কারওয়ান বাজারে মানববন্ধন করে। তারা অভিযোগ করেছে, গত মে মাসে কোনো ধরনের নোটিস ছাড়াই অন্যায়ভাবে নির্বাহী আদেশে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। নির্বাহী আদেশে তাদের চাকরি পুনর্বহাল করার দাবি জানিয়েছে।
শিক্ষা ভবনের অদূরে বিভিন্ন সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধনে দাঁড়ায় ডিপ্লোমা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বাংলামোটরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের সামনেও একটি দলকে দাবি আদায়ে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কারওয়ান বাজারে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সামনে সকালে একদল মানুষ অবস্থান নিয়ে নানা দাবিতে স্লোগান দেন। ঢাকার সাভারের আশুলিয়া ডিইপিজেডের পোশাক কারখানায় তাৎক্ষণিক চাকরির দাবিতে কয়েকদিন যাবত বিক্ষোভ করছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। জাতীয় গৃহায়ণে মাস্টার রুলে নিয়োগপ্রাপ্ত ওয়ার্কচার্জড কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলন করছে দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য শিকার হওয়া কর্মচারিরা। গৃহায়ণ অধিদফতরের নিচে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ দাবি জানানো হয়। এ সময় তারা চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন এবং জাতীয় গৃহায়ণের চেয়ারম্যান মো. হামিদুর রহমান রুম ঘেরাও করেন।
এসব ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বাদ প্রতিবাদের অভাব নেই। বলা হচ্ছে, সব সেক্টর একযোগে পরিকল্পিতভাবে বৈষম্য-বঞ্চনা নিয়ে বার্গেনিং শুরু করেছে। এটা মূলত অসহযোগিতা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র। সরকারি চাকরি কোন ট্রেড ইউনিয়ন নয়। তাদের দাবি দাওয়া থাকতে পারে, কিন্তু সেই দাবির সঙ্গে চাকরিতে যোগ দেয়া-না দেয়ার শর্ত থাকতে পারে না।
অতীতে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো গঠিত হয়েছিল, সেই সব সরকারের প্রধান কাজ ছিল কেবলই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাষ্ট্র সংস্কার করার মহান দায়িত্ব এ সরকারের কাধে চাপানো হয়েছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সাভাবিক রাখার পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে রাষ্ট্র সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। সংস্কার সহজ কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে সকল মহলের সার্বিক সহায়তাসহ সহানুভূতি থাকতে হবে। দাবি দাওয়া পূরণের আল্টিমেটাম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থেই। এর পরিবর্তে অরাজকতা সৃষ্টির যে কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্র হিসেবেই পরিগণিত হওয়া উচিত।
(লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক)