হাতিলেইট গ্রামটি ‘আধিবাসী গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। গ্রামটি কৃষিপণ্যের জন্য বিখ্যাত। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই দরিদ্র। দিন আনে দিন খায়। এ গ্রামের স্বশিক্ষিত দিনমুজুর মফিদুল ইসলাম। প্রাথমিকের গন্ডি পেরোতে পারেনি, অথচ নিজে গান লিখে ও কণ্ঠ দেয়। তাঁর জীবনে স্বপ্ন ছিল দেশের নামকরা ‘কণ্ঠ শিল্পি’ হওয়ার। দিন মুজুরির টাকা জমিয়ে অডিও ক্যাসেট বের করতে ইট পাথরের যান্ত্রীক শহর ঢাকায় পারি জমিয়েছিলেন। সেখানে দালালের খপ্পরে পরে সব খুইয়েছেন। কণ্ঠ শিল্পি হওয়ার স্বপ্ন অঁধরা থেকে যায়। চলে আসেন গ্রামে। দারিদ্রতার কষ্টাঘাতে অন্যের জমিতে আবারও দিনমুজির কাজ শুরু করেন। স্বপ্ন দেখেন নতুন করে ‘সাবলম্বি’ হওয়ার। নামকরা কণ্ঠ শিল্পি হওয়ার স্বপ্ন পুরন না হলেও সাবলম্বি হওয়ার স্বপ্ন পুরন হয়েছে।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেই দক্ষিণপাড়া গ্রামের মহির উদ্দিনের পুত্র মফিদুল ইসলাম। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার তাঁর। গত চার বছর আগেও অন্যের জমিতে দিন মুজরের কাজ করতেন। এখন তাঁর বাড়িতেই প্রতিদিন কাজ করে ৩-৪ জন শ্রমিক। তাঁর জীবনের সাবলম্বি হওয়ার চাকা ঘুরিয়েছে ‘কোয়েল পাখি’। চার সন্তানের মধ্যে জান্নাতুল ও লুভনা মাদরায় পড়ে, জুনাইদ ও জোবায়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাঁর দেখাদেখি অন্য গ্রামের মানুষও কোয়েল পাখির খামার করতে ঝুঁকছে।
২০১৬ সালের শেষের দিকে ঘাটাইল উপজেলার সিদ্দিকালি বাজারে মফিদুল ইসলামের সাথে দেখা হয় তাঁর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বন্ধু কাউসার মির্জার সাথে। উভয়ে দীর্ঘ সময় চায়ের আড্ডায় গল্প করেন। সংসারে অভাবের কথা শুনে তাঁকে অল্প টাকায় কোয়েল পাখির খামার করতে পরামর্শ দেয়। সব ধরণের সহযোগীতার আশ্বস্ত করে বন্ধু কাউসার মির্জা। বন্ধুর কথামতো ২০১৭ সালে বাড়িতে খুপড়ি ঘর তৈরি করে। বন্ধুর দেয়া ঠিকানা অনুযায়ি বগুড়া গিয়ে একদিন বয়সের ১০০০ কোয়েল পাখির বাচ্চা কিনে নিয়ে আসে ৭০০০ টাকা দিয়ে। বাচ্চা গুলো পালন শুরু করে। গ্রামের পাশে একটি বাজার থেকে বাকিতে মুরগির খাবার কিনে কোয়েল পাখির বাচ্চা গুলোকে খাওয়াতে থাকে। বাচ্চার বয়স যখন ৩৫-৪০ দিন তখন ডিম দিতে শুরু করে। কোয়েল পাখির ডিম দিতে শুরু করায় মহাখুশি হয় মফিদুল ইসলাম। পাখির বয়স যখন ৬০-৭০ দিন তখন প্রতিদিন ৪৫০-৫০০ ডিম দেওয়া শুরু হয়। ডিম উৎপাদনের তুলনায় হাট-বাজের নিয়ে বিক্রি করতে পারেনি। নষ্ট হয়েছে বেশির ভাগ ডিম। তাঁরপরও হাল ছাড়েনি মফিদুল ইসলাম।
২০১৮ সালে ডিম বিক্রির জন্য ঢাকায় এক আড়ৎ মালিকের সন্ধান পায়। ঐ বছর গ্রাম থেকে ঋণ নিয়ে খামারের পরিসর বড় করে ৫,০০০ হাজার কোয়েল পাখি পালন করে। এক বছরের ৬ লাখ টাকা লাভবান হয়। ২০১৯ সালের শুরুতে খামারের পরিসর আরও বড় করে ১০,০০০ কোয়েল পাখি উঠায়। এখন প্রতিদিন ৭০০০ থেকে ৭৫০০ ডিম দেয় তাঁর খামারে। পাঁচদিন পর পর বাড়ি থেকে মিনি ট্রাকে করে ৩৫ হাজার থেকে ৩৭ হাজার ডিম ঢাকার কাপ্তান বাজারে আড়ৎতে পাঠিয়ে দেয়। ডিমের বাজার উঠানামা করে। বর্তমানে ২ টাকা দর ডিম বিক্রি করছেন। খরচ বাদে প্রতি মাসে তাঁর লাভ হয় এক লাখ টাকার উপরে। ১ বছর কোয়েল পাখি থেকে ডিম উৎপাদন করে। এরপর প্রতিটি কোয়েল পাখি ২৫-৩০ টাকা দরে রিজেক্ট হিসেবে বিক্রি করে দেয়। বিক্রির করার ১৫ দিনের মধ্যে খামারে নতুন বাচ্চা উঠায়। দিনমুজুর মফিদুল ইসলামকে এখন আর অন্যের জমিতে কাজ করতে হয়না। স্বপ্ন দেখতে একদিন সাবলম্বি হবে, কোয়েল পাখিতে সাবলম্বি হওয়ার সপ্ন পুরন হয়েছে তাঁর। নিজেই এখন সাবলম্বি। ছেলে-মেয়েদের এখন লেখা পাড়া করাচ্ছে। প্রতিদিন ৩-৪ জন দিনমুজুর শ্রমিক তাঁর বাড়ি ও জমিতে কাজ করেন।
গত শুক্রবার বিকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পূর্ব পাশে বিশাল একটি কোয়েল পাখির খামার। পাখি গুলোকে খাবার দিচ্ছে মফিদুল। ঘরের চারদিকে তারের ন্যাট দিয়ে বেড়া। তিনটি ভাগে আলাদা আলাদা করে রাখা হয়েছে কোয়েল পাখি গুলো। এছাড়াও খাঁচি রয়েছে ১২ টি। প্রতিটি খাচিতে রয়েছে কোয়েল পাখি। প্রায় ৮ হাজার কোয়েল পাখি রয়েছে খামারে। পাখি গুলোর বয়স ৬০ -৬৫ দিন। মুরগির যে খাবার কোয়েল পাখিরও একই খাবার।
মফিদুল ইসলাম বলেন, বন্ধুর পরামর্শে মাত্র ১০০০ কোয়েল পাখির বাচ্চা কিনে লালন পালন শুরু করি। প্রথম বছর ডিম তেমন বিক্রি করতে না পারায় লাভ হয়নি। তবে বুঝতে পেরেছিলাম কোয়েল পাখিতে সাবলম্বি হওয়া যাবে। বর্তমানে ৮০০০ কোয়েল পাখি থেকে খরচ বাদে প্রতিমাসে প্রায় এক লাখ টাকার উপরে লাভ হয়। অনেকে আমার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে কোয়েল পাখির খামার করছে। কোয়েল পাখি যে কেউ পালন করতে পারবে। খরচ কম, লাভ বেশি।