উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের লাগাম টানা হচ্ছে। কেউ প্রভাব বিস্তার করলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে এমপি-মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন কেউই ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না। এমন নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গতকাল সকালে দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সারা দেশে এমপি-মন্ত্রীদের তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) কড়া বার্তা দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বেলা ১১টায় দলের সাধারণ সম্পাদক বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নিয়ে ধানমন্ডিতে দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয়ে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে দলীয় সভানেত্রীর বার্তা সারা দেশে এমপি-মন্ত্রীদের পৌঁছে দিতে নির্দেশনা দেন ওবায়দুল কাদের। বৈঠক শেষে সাংগঠনিক সম্পাদকরা নিজ নিজ বিভাগের নেতাদের টেলিফোনে দলের প্রধানের বার্তা পৌঁছে দেন। সভানেত্রীর বার্তা না মানলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তারা। দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না-এ ধরনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আমাদের এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা বৈঠক শেষ করেই নিজ নিজ বিভাগে বার্তা পৌঁছে দিয়েছি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রী পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দলের অনেক সিনিয়র নেতাকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।’ এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিচ্ছে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণতা করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেউ যেন নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে-সে বিষয়ে অনেক আগে থেকেই কঠোর বার্তা দেওয়া হচ্ছিল দলের পক্ষ থেকে। কিন্তু দলের প্রভাবশালী নেতা ও স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী স্ব স্ব নির্বাচনি এলাকায় তাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের প্রার্থী করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের বসিয়ে দিচ্ছেন। কারও কারও আত্মীয়স্বজনের নামে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে অপহরণের অভিযোগও উঠেছে। এ কারণে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে। এমপি-মন্ত্রী প্রশাসনের ওপর খবরদারি করছেন। সে কারণে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন, এমপি-মন্ত্রী পরিবারের সদস্যরা নির্বাচন করতে পারবে না। দলীয় প্রধানের কঠোর বার্তা পেয়ে গতকাল দলের সাধারণ সম্পাদকসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা নড়েচড়ে বসেন। প্রথমে বৈঠক করেন।
ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, আফজাল হোসেন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ। উপস্থিত একাধিক নেতা জানান, নির্বাচনে হস্তক্ষেপ না করার জন্য দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, শাজাহান খান, নোয়াখালীর এমপি একরামুল করিম চৌধুরী, মোহাম্মদ আলীসহ বেশ কয়েকজনকে তাৎক্ষণিক বৈঠক থেকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। বৈঠক সূত্র আরও বলছে, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অধিকাংশ নেতার অভিমত ছিল দলীয় প্রতীকের কারণে তৃণমূলে দলাদলি বাড়ছে। এ কারণে প্রতীক বাদ দেওয়া হয়। সে কারণে আওয়ামী প্রতীক রাখেনি। বৈঠকে বলা হয়, যেখানে দল মনোনয়ন দিচ্ছে না, সেখানে তারা খবরদারি করছে। আধিপত্য বিস্তার ও মাইম্যান সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। এমপি-মন্ত্রীরা নিজের প্রভাব বৃদ্ধি ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য যে রাজনীতি করছেন তা আওয়ামী লীগ পছন্দ করছে না। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইতোমধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
যারা নিকটাত্মীয়দের দিয়ে নির্বাচন করাচ্ছেন, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। কেউ যদি দলীয় নির্দেশনা না মানেন, তাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এবার চার পর্বে উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। প্রথম পর্বে ১৫০টি উপজেলায় ভোট হবে। প্রথম পর্বে ১৪ উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়রা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। মন্ত্রী-এমপিদের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত উপজেলা নির্বাচনের চার পর্বের জন্যই প্রযোজ্য বলে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে। দলের দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা চান প্রভাবমুক্ত, অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ উপজেলা নির্বাচন। সে কারণেই এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব বিস্তার না করার জন্য জরুরি নির্দেশনা দিয়েছেন। দলীয় প্রধানের এই বার্তা আমরা পৌঁছে দিচ্ছি।’ ২ মে জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসছে। এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক ডাকা হতে পারে। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নিজে মন্ত্রী ও এমপিদের উপজেলা নির্বাচন বিষয়ে তাঁর অবস্থান তুলে ধরবেন। প্রভাব বিস্তার থেকে বিরত থাকার বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন। এ ছাড়া শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদেরও বৈঠক হতে পারে। সেখানেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করলে বহিষ্কারের বিধান রয়েছে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে।