প্রকাশের সময়: বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪ । ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ প্রিন্ট এর তারিখঃ মঙ্গলবার, ১ জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

দেশবাসী এমন নির্বাচন প্রত্যাশা করেনি

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম।।

।।বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম।।

বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুন্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু? হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিশ্চয়ই ব্রিটিশের বিবেচনায় বিদ্রোহী। কিন্তু আমাদের দিক থেকে কখনো কোনোকালে বিদ্রোহী নন। আমাদের চোখে সব সময় তিনি বিপ্লবী, পরম বিপ্লবী। আমার অবস্থাও এখন প্রায় অনেকটাই বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক অভিনব অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্ম। ওর আগে আমি জাতীয় সংসদে নৌকা মার্কার সদস্য ছিলাম। নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল- ১. ৮২ আটিয়া বনাধ্যাদেশ বাতিল করা হবে ২. এক কোটি বেকারের চাকরি ৩. মানুষের আর সার খুঁজতে হবে না, সারই মানুষ খুঁজবে, সর্বোপরি ৪. পাটের দাম দেওয়া হবে ৫০০ টাকা।

তিন বছর পার হওয়ার পর বন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় পুরো কমিটি সখীপুরে এসে সরেজমিন তদন্ত করে রিপোর্ট পেশ করার পরও যখন ৮২ আটিয়া বনাধ্যাদেশ বাতিল করা হলো না। ১ কোটি বেকারের চাকরির জায়গায় সর্বমোট তিন-সাড়ে ৩ লাখ চাকরি, ৩৩০ টাকার সার বিনামূল্যে দেওয়া হবে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর বোনের নেতৃত্বে আওয়ামী সরকার গঠিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে ৩৩০ টাকা থেকে সারের দাম উঠে গেল ৪৫০ টাকায়, পাটের দাম ৫০০ টাকা দেওয়ার স্থলে নেমে এলো ১০০-১২০ টাকায়। যে কারণে শত শত কৃষক মহাসড়কের নানা স্থানে পাট ফেলে আগুনে জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করল। এসব দেখে তিন বছরের মাথায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনার সঙ্গে কথা বললাম।

তিনি অনেক কিছুই বলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। যে কারণে সখীপুর-বাসাইলে জনসভা করে অনুমতি নিয়ে ২৯ আগস্ট ’৯৯ সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলাম। আওয়ামী লীগের সঙ্গেও সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলাম। তারপরও আমার বিরোধীরা আওয়ামী লীগ আমাকে বহিষ্কার করেছে বলে চালানোর চেষ্টা করেছে।

কিন্তু তাতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। আমি যেদিন সখীপুরে মিটিং করে পদত্যাগের কথা বলেছিলাম সেদিন সভা শেষে সখীপুর পাইলট স্কুলে প্রায় ১ ঘণ্টা ছিলাম। নেতৃবৃন্দ অনেকেই জারজার হয়ে কেঁদেছিলেন। সাধারণত সভা শেষে দর্শক-শ্রোতারা বেশি সময় থাকে না। কিন্তু সেদিন জনসভার অর্ধেকের বেশি মানুষ সখীপুর ছাড়েনি। তারা ছটফট করছিল, কেউ কেউ কাঁদছিল। ওটা ছিল আমার জীবনে এক শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। মানুষ মানুষকে কতটা ভালোবাসতে পারে সেটা ছিল তার বহিঃপ্রকাশ। এরপর ১৫ নভেম্বর সখীপুরে উপনির্বাচন হয়। আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। রাস্তাঘাটে হাটে-মাঠে আমরা প্রতীক হিসেবে গামছা পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু আমাদের গামছা দেওয়া হলো না। এক নাবালককে দিয়ে গামছা চাওয়া হলো। যেহেতু তখনো গামছা দলীয় পছন্দের প্রতীক ছিল না, সেহেতু গামছা নিয়ে লটারির প্রস্তাব দেওয়া হলো। আমি সে প্রস্তাবে রাজি হতে পারিনি। কারণ লটারি করে প্রতীক নেওয়ার কোনো আগ্রহ বা ইচ্ছা আমার ছিল না। চলে এসেছিলাম। পরে আমাকে পিঁড়ি দেওয়া হয়েছিল। আমাদের এলাকার লোক যাকে বলে ফিরা। এটা ছিল বেলা এক-দেড়টার সময়ের কথা। আমাদের অনেক বড় বড় নেতা তার মধ্যে হামিদুল হক বীরপ্রতীক, প্রধান শিক্ষক আবদুল হাই, ইদ্রিস সিকদার, লাল মিয়া, আজিজ মাস্টার এরকম আরও অনেকে তাদের কান্নাকাটি শেষ হলে ৪টার দিকে গিয়েছিলাম বাসাইলের মটরা। শতাধিক বাচ্চা পোলাপান চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম-নবম শ্রেণি হবে। তাদের একজনও ভোটার না। স্লোগান দিয়ে আসছিল, ‘গামছা ছিঁড়া-ফিঁড়া দিছে। ’ মনে হয় সেদিন মটরা বাজারের সভায় গ্রামের একজনও অনুপস্থিত ছিল না। সেখান থেকে গোড়াই ঘুরে সখীপুর যাই। সেই জীবনে প্রথম সখীপুর থানার ভিতরে যাওয়া। কালমেঘার শাহীন, আরও কাকে যেন গ্রেফতার করে আনা হয়েছিল। গারদের সামনে গেলে শাহীন আমার হাত ধরে বলেছিল, ‘দাদা, আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না। আপনি নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়ে যান। আমরা সবাই আছি আপনার সঙ্গে। ’ গিয়েছিলাম বড়চওনা গরু হাটে। মনে হয় না আর কোনো দিন বড়চওনা গরু হাটে অত মানুষ একত্র হয়েছিল। আমি প্রাণ খুলে কথা বলেছিলাম। আমাদের কাছে প্রতীক হিসেবে গামছা ছিল না। কামালিয়াচালা মাদরাসার প্রিন্সিপাল আবদুল করিম এবং ফয়েজুদ্দিন হাজী এ দুজন পদত্যাগ করার পরপরই এক সভায় বলেছিল, স্যার আপনার কোনো মার্কা লাগবে না। যদি মার্কা না থাকে আপনি কেন্দ্রে কেন্দ্রে দাঁড়াবেন। আমরা আপনার পিঠে সিল মেরে দেব। ইচ্ছা করলে কাঁধে যে গামছা নিয়ে ঘোরেন। গামছাও আপনার প্রতীক হিসেবে নিতে পারেন। ’ আমি খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। কারণ সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে গামছা আমার নিত্যসঙ্গী। যে কোনো সভা-সমাবেশে আমার কাঁধে গামছা থাকত এখন যেটা গলায় থাকে। আমি খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছিলাম। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সারা এলাকা গামছা হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনে যে জনসম্পৃক্ততা হয়েছিল সখীপুর-বাসাইলের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুপযুক্ত অনেক উপদেষ্টা বলেছিল, কাদের সিদ্দিকীকে কোনোমতেই সংসদে আসতে দেওয়া যাবে না। তা তারা করেছিল। মাগুরার ভোট চুরি নিয়ে দেশব্যাপী মারাত্মক তোলপাড় হয়েছিল। কিন্তু সখীপুরের ভোট ডাকাতি নিয়ে বিরোধী দল কিছুই করেনি। তার অন্যতম কারণ এখানে বিএনপির নেতা যিনি ’৯০-এর আগ পর্যন্ত এক দিনও রাজনীতি করেননি। তিনি বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের কোম্পানির ইনকাম ট্যাক্সের উকিল। সে সুবাদে বেশ বড় নেতা। আমি তখন সে সমস্ত বুঝতাম না। এখনো অনেক কিছু বুঝি না। সেবার নির্বাচনে শওকত মোমেন শাজাহানকে জেতানোর জন্য নির্বাচনি বিধিমালা ভঙ্গ করে নির্বাচনের মধ্যে সখীপুরের জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকার নানা প্রজেক্ট ঘোষণা করা হয়। আওয়ামী লীগের বহু নেতার কাছ থেকে পরে শুনেছি, দুই উপজেলায় ৪০ হাজার ভোট আগেই বাক্সে ভরে রেখেছিল। তারপরও যখন দেখা যাচ্ছিল যে ফলাফলে নৌকা হেরে যাচ্ছে, তখন সখীপুরের দুই কেন্দ্র, বাসাইলের দুই কেন্দ্র বন্ধ রেখে ফল ঘোষণা স্থগিত করে দেয়। এই চার কেন্দ্রে ১৮ হাজারের মতো ভোট ছিল। তখনো নৌকা পিঁড়ির চাইতে ১২-১৩ হাজার ভোট পেছনে। বহু কারসাজি করে বন্ধ চার কেন্দ্রে ভোট হয়। সেখানে প্রায় শতভাগ নৌকার পক্ষে কাস্ট করা হয়। তখন এখনকার মতো একেবারে এত মেরুদন্ডহীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন ছিল না। আমি কুতুবপুর-বড়চওনার মাঝামাঝি নাসিরদের বাড়ি বসে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ পাঠিয়ে ছিলাম। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ফল স্থগিত রাখা হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কচুয়া কেন্দ্রে খুব সম্ভবত আমি পিঁড়ি মার্কায় ১৮৮০ ভোট পেয়েছিলাম। নৌকা পেয়েছিল ১৮৩ ভোট। অন্যান্য কেন্দ্রে চুরি-চামারি সরকারি লোকজনের অসৎ পন্থা অবলম্বন দেখে সেই সময়ের এক ইলেকশন কমিশনার মোস্তাক চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনার হওয়া আমার জীবনে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। আমি যদি এখনই পদত্যাগ করতে পারতাম তাহলে সেটা আমার জন্য সব থেকে সম্মানের হতো। ’ ’৯৯ সালে আমার পদত্যাগের সময় পর্যন্ত শওকত মোমেন শাজাহানের একটা মোটরসাইকেল ছিল। কারচুপির নির্বাচনে অংশ নিয়েই তার গাড়ি হয়ে যায়। ভাগ্য ফিরতে থাকে। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে সে তখনো শপথ নিতে পারেনি। দুই বছর পর আবার সংসদ নির্বাচন ঘোষণা হলে নির্বাচনের এক-দেড় মাস আগে শাজাহান আমার বাড়ি এসে বলে, ‘স্যার, আপনি যদি মামলাটা তুলে নেন তাহলে এ কদিনের জন্য আমি শপথ নিতে পারি। মামলা তুলে না নিলে সর্বত্র নির্বাচন হলেও সখীপুর-বাসাইলের আসনে মামলা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্বাচন হবে না। আমি মামলা তুলে নিয়েছিলাম। ততদিনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ ছিলেন আইন উপদেষ্টা। আমি সেদিন নির্বাচনি প্রচারে ঘাটাইল ধলাপাড়ায় ছিলাম। আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমেদ ফোন করে জানিয়ে ছিলেন, ‘বঙ্গবীর, আপনার দলকে আপনার মার্কা গামছা অনুমোদন করে দিলাম। ’ তার আগের ঘটনা ১৫ অক্টোবর ভোটের কারচুপির পরপরই ২৪ ডিসেম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে আমরা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্ম দিয়েছিলাম। আমাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন ড. কামাল হোসেন, বিশেষ অতিথি ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। গামছার দলের জন্ম নির্বিঘ্ন হয়নি। সরকারি দল আওয়ামী লীগের হামলায় ১০৪ জন আহত হয়েছিল। যার দুজনের চোখ ও চারজনের হাত-পা নষ্ট হয়েছিল। পরে ২০০১ সালের নির্বাচনে প্রচুর ভোটে গামছা জয়ী হয়েছিল। পাঁচ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে সংসদে দায়িত্ব পালন করেছি। এবার আসি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। অনেকগুলো বছর তেমন নির্বাচনই হয়নি। এ বছরও ভালো নির্বাচন হয়েছে তা বলা যাবে না। কারণ প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনটি খুব বেশি উৎসবমুখর ছিল না। উপরন্তু কোথাও তেমন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। জোট সরকারের নৌকা মার্কা নিয়ে অনেকেই নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরেছে। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন হয়ে যাওয়ার পরও জাতীয় পার্টির ২৬ জনকে জেতানোর জন্য নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করা হয়। তার মধ্যে ১১ জন পাস করেছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এখন যদি সব সত্য বলি তাহলে তো সরকারের কিছুই থাকে না। নির্বাচনের পর আমরা এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলাম না কেন অনেক নেতা-কর্মীর এমন অনুযোগ। আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করলে দেশে অরাজক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির যদি সৃষ্টি হয়। আমি সেটা চাই না। বললে কেমন শোনাবে, এক কাজির কাছে এক সন্তানের দাবিদার দুই মা উপস্থিত হয়েছিল। দুজনই শিশুটিকে তাদের নিজের সন্তান বলে বিচারের সময় দাবি করছিল। কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছিল না। কাজি যখন একপর্যায়ে বললেন, ঠিক আছে আপনারা যখন একজনও শিশুটিকে ছাড়বেন না, তখন আর কী করা? একে সমান দুই টুকরো করে দুজনকে দিয়ে দেওয়া হোক। আসল মা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠে, কাজি সাহেব এ সন্তান আমার না। আপনি ওকে দিয়ে দিন। তবু সন্তানটিকে দুই টুকরো করবেন না, হত্যা করবেন না। কাজি এবং সভাসদরা তখন বুঝে ফেলেন শিশুটির প্রকৃত মা কে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আমার ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই হয়েছে। ঠিক এই সময় আমি কোনো কিছু করলে হঠাৎ যদি বারুদে আগুনের মতো হয়ে যায় সামলানোর কিছু থাকবে না। নির্বাচনের এক দিন পর কালিহাতীতে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ট্রাক মার্কার সমর্থক কয়েকজনকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে থানায় ধরে আনা হয়েছিল। লতিফ ভাই বয়সী মানুষ। সকালে মুখে তুলতে যাওয়া নাশতা ছেড়ে তিনি কালিহাতী এসে থানার সামনে বসে পড়েন। তার কর্মীদের না ছাড়লে তিনি উঠবেন না। রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায়। চারদিক থেকে হাজার হাজার ট্রাকের সমর্থক ছুটে আসে। সেখানে পরাজিত প্রার্থীর শতাধিক লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে অবরোধে হামলা করতে আসে। শেষ পর্যন্ত তারাই জনতার লাথিগুঁতা খেয়ে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে কালিহাতীতে গেলে লতিফ ভাই আমাকে থানায় যেতে বারণ করেন, ‘যতক্ষণ সবাইকে ছেড়ে না দেয় তুমিও থানায় যেতে পারবে না। ’ অনেক বলে-কয়ে থানায় গিয়ে দেখি ঊর্ধ্বতন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা অনেক আর্মড পুলিশ নিয়ে শঙ্কিত অবস্থায় ঘোরাফেরা করছেন। তারা কেউ ওরকম অবরোধ বা থানা ঘেরাও তাদের কর্মজীবনে কখনো দেখেননি। অবরোধ চলাকালীনও কয়েকজনকে ধরেছিল। এজাহারভুক্ত দুজন ছাড়া বাকিদের তখনই ছেড়ে দেওয়া হয়। যার একজনের জিম্মা আমি নিজে হয়েছি। সেটাই হয়তো কালিহাতী থানায় আমার জীবনে একটাই স্বাক্ষর। এজাহারভুক্ত দুজনকে কোর্ট থেকে তখনই জামিন দেওয়া হবে এই শর্তে টাঙ্গাইল পাঠিয়ে দিয়ে বাকিদের নিয়ে লতিফ ভাইকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি অবরোধ তুলে বাড়িতে চলে আসেন। আমি সেখানেও কোনো ঝামেলা হোক, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটুক এটা চাইনি। যে কারণে সখীপুরের নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে কোনো আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিন্তা করিনি। কারণ আমি বুঝি, দেশ বড় বেশি কঠিন অবস্থার ভিতর দিয়ে চলেছে।

সারা জীবন দেখে এসেছি, চিৎ হয়ে থুথু ছুড়লে ফিরে এসে বুকে পড়ে। এখন আমার তেমনটাই হয়েছে। আমি চেয়েছিলাম প্রভাবমুক্ত উৎসবমুখর নির্বাচন। বলতে বুকে বাধলেও নির্বাচন হয়েছে শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। তাও বহু জায়গায় লোকজন ভোট দিতে পারেনি। জোর-জবরদস্তি করে অনেকে বাক্স ভরেছে। কারও কারও তো ভোটের বাক্সের প্রয়োজনই হয়নি। ড. রাজ্জাক মুক্তিযুদ্ধে একেবারে শেষের দিকে কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তাও লতিফ ভাইয়ের চিঠির বদৌলতে। মূলত লতিফ ভাই তার প্রধান নেতা। বাপ মারা গেলে ড. রাজ্জাক নানার বাড়িতে মানুষ। কারণ তার মার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছিল। লতিফ ভাই একসময় তাকে অনেক টাকা-পয়সা দিতেন। না, রাজ্জাকরা একেবারে হতদরিদ্র ছিলেন না। ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে লতিফ ভাই সহযোগিতা করতেন। স্বাধীনতার পর ময়মনসিংহ থেকে রাজ্জাক যতবার টাঙ্গাইল এসেছেন তাকে ততবারই ইনভেলাপে ভরে টাকা দিয়েছি। সে টাকার পরিমাণ মোটেই কম হতো না। তখনকার সময় ডিসি, এসপি, এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, সুপারিনটেন্ড্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার যে পরিমাণ বেতন পেতেন তার ৪-৫ গুণ হতো। নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আবুল হাসান চৌধুরী তার মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে রাখলে ড. রাজ্জাকের কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ থাকত না। টাঙ্গাইল-২, সেখানে কোনো নির্বাচনই হয়নি। গোপালপুরের ওসি লাঠিয়ালের চেয়ে খারাপ আচরণ করেছেন। ওসিকে সরিয়ে দিতে যেখানে যেখানে বলা দরকার বলার চেষ্টা করেছি। নির্বাচনি বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে এ নিয়ে অনেকবার কথা হয়েছে। নির্বাচনের আগের দিন কয়েক বড় কর্তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, স্যার, খবর পেলাম আপনার সখীপুর-বাসাইলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সব প্রিসাইডিং এবং সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের টাকা দিয়েছে। আমরা তথ্য নিচ্ছি। প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নেব। শুধু প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং কেন, সব জায়গায় যে পরিমাণ টাকার দরকার তার চেয়ে বেশি দিয়েছে। সখীপুরে নির্বাচনে কারচুপি হবে এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি এবং সে কারচুপির সঙ্গে সরকারি দল জড়িত হবে এটা ভাবতেও আমার অবাক লাগে। এবারের নির্বাচন বিশেষ করে টাঙ্গাইলে ড. রাজ্জাক সবচেয়ে জঘন্য কাজ করেছেন। নির্বাচনি ফলাফল উপজেলায় চলে আসার পরও আড়াই-তিন ঘণ্টা লতিফ ভাইয়ের ট্রাকের ফল ঘোষণা করা হয়নি। হাজার হাজার মানুষ ইউএনও অফিস ঘেরাও করায় তিন-সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর তা ঘোষণা করা হয়েছে। মির্জাপুরেও একই রকম করেছে। ঘাটাইলে সরকারি প্রার্থী ছিল একেবারে অপরিচিত জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি থেকে দূরে, তাই সেখানে দাঁত ফোটেনি। মির্জাপুরে তো কোনো ভোটই হয়নি। আর টাঙ্গাইল-৮ এ অভিনব কায়দায় ভোট চুরি করা হয়েছে। আমি দুপুর ১২টা থেকেই শুনছিলাম ৩০ হাজার নৌকায় সিল মারা ভোট এসেছে। সেগুলো প্যাকেট ছিঁড়ে বাক্সও ভরেনি। ভোট গণনার সময় যেভাবে রাবারের ব্যান্ডে বাঁধা হয়, ঠিক সেভাবে প্যাকেট মহিলা সহকারী প্রিসাইডিংরা শীতের দিন বলে চাদরের নিচে রেখে গণনার সময় শুধু প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিয়েছে। কয়েক জায়গায় গামছার এজেন্টরা আপত্তি তুললে তাদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত ভোট মিল নেই। কিছু কিছু সহকারী প্রিসাইডিং আপত্তি তুললে প্রিসাইডিং অফিসাররা বলেছে, আপনারা চুপ থাকেন। এ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। তারা আর ঘামায়নি। প্রায় ৫০টা কেন্দ্রে ভোট শেষ হওয়ার সময় আমাদের যে হিসাব দেওয়া হয়েছিল পোলিং এজেন্টরা যে হিসাব পেয়েছে তার চেয়ে ৩০০-৪০০, এমনকি ৯০০ ভোট বেশি দেখানো হয়েছে। নির্বাচনের দুই দিন আগে থেকে নৌকা প্রার্থী সখীপুর ছেড়ে দিয়েছিল। নির্বাচনের আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত বড় বড় হোতাকে টাঙ্গাইল হোটেলে খেতে দেখা গেছে। পরদিন তারাই কি এমন জাদু করে ভোজবাজির মতো বিপুল ভোটে জিতে গেল! নির্বাচনি আইনে কোনো গাড়ি ঘোড়া চলবে না, অথচ সরকারি দলের সব চলেছে। কোথাও কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেখা যায়নি। ৫টা-সাড়ে ৫টার আগে কোনো কেন্দ্রেই ফলাফল ঘোষণা হয়নি। কিন্তু সরকারি প্রার্থীর লোকজন সাড়ে তিন, পৌনে চারটা থেকেই কী করে সখীপুরের তালতলায় বিজয় মিছিল শুরু করে? এসব সরকারি গোয়েন্দা রিপোর্টেও আছে। তাই ব্যাপারগুলো বলতে বুকে বাধে। কখনো কখনো মনে করতে ইচ্ছা হয় তাহলে কি সখীপুর-বাসাইলের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে চায় না? স্বাধীনতায় যদি কোনো ভূমিকা থাকে এখন জীবিতদের মধ্যে সেটা একেবারে নগণ্য নয়। তাহলে কি সখীপুর-বাসাইল-টাঙ্গাইলের মানুষ স্বাধীনতা চায় না? বঙ্গবন্ধু হত্যার একমাত্র প্রতিবাদকারী আমি। বহু লোক জীবন দিয়েছে। তাহলে কি বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ করায় মানুষ নাখোশ হয়েছেন? আমি তো আওয়ামী লীগ ছেড়েছিলাম ৮২ আটিয়া বনাধ্যাদেশ বাতিল না করার জন্য। তবে কি পাহাড়ের মানুষ আটিয়া বনাধ্যাদেশ নিয়ে সুখে শান্তিতে আছে? ইচ্ছা না থাকলেও এসব প্রশ্ন মানুষের সামনে আসে। এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এই তো তিন দিন আগে একটানা পাঁচ দিন সখীপুর থেকে এলাম। রাস্তায় স্কুল মাঠে শত শত লোকের সামনে বাড়ি বাড়ি থেকে এনে দুপুরের খাবার খেলাম। রাস্তার পাশে যেখানেই নিষ্পাপ অবুঝ শিশুরা আমাকে দেখেছে সেখানেই আনন্দে গামছা গামছা স্লোগান দিয়েছে, এসবই কি মূল্যহীন? আমি যদি খালাস নিয়তে বলতে পারতাম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়ী হয়েছে তাহলে আমার চেয়ে আনন্দিত আর কেউ হতো না। কিন্তু চুরি-চামারি করে জাতিকে এ ধরনের অপমানে খুবই কষ্ট লাগে। নির্বাচনি এলাকায় ঘোরাফেরার জন্য সময় করতে পারিনি। তাই পরে পাঠকরা যাতে সব রকমের সঠিক তথ্য-উপাত্ত পান সেই চেষ্টা অবশ্যই করব। সেদিন বাসাইলে একটি কর্মিসভা হয়েছে। অমন জমজমাট কর্মিসভা নির্বাচনে পরাজয়ের ব্যথা বুকে নিয়ে হতে পারে আমার কল্পনার বাইরে ছিল। যেখানে ৩০০-৪০০ মহিলা ছিল। সবাইকে বলেছি, আশা হারালে চলবে না। গামছার দল করেছি সুখে-দুঃখে মানুষের পাহারা দেওয়ার জন্য। আমরা উপযুক্ত পাহারাদার হতে পারলে সেটাই হবে আমাদের পরম ও চরম সার্থকতা।

 

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

প্রকাশক ও সম্পাদকঃ মোঃ মাইন উদ্দিন উজ্জ্বল, প্রধান সম্পাদকঃ শিবলী সাদিক খান, নির্বাহী সম্পাদকঃ জহির রায়হান,  বার্তাকক্ষঃ 75bdnews@gmail.com

প্রিন্ট করুন