সব
ফুলবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী জমিদার আমলের ঘুঁটি খেলা শুরু হয় দুপুরে। এবছর খেলাটি বয়স ২৬৪ তম। গতকাল শনিবার সকাল থেকে ঘুঁটি খেলার স্থল ফুলবাড়িয়ার বড়ইআটা গ্রামের হাজার হাজার মানুষ্ উপস্থিত হতে থাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকালে খেলার মাঠে লাখ মানুষের ঢল নামে। বিভিন্ন উপজেলা থেকে এসব মানুষ ঘুঁটি খেলতে ও দেখতে আসেন।
সকাল থেকে দল বেঁধে শত শত খেলোয়াড় ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে খেলার মাঠে চলে আসেন। দুপুর ৩ টার দিকে ‘হুম ঘুঁটি’ স্মৃতি সংসদের সদস্যরা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বড়ই আটা পরগনা ও তালুক সীমান্তে ধানের পতিত জমিতে ৪০ কেজি ওজনের ঘুঁটি নিয়ে আসে খেলোয়াড়দের মাঝে ছেড়ে দেয়। এরপর চারদিক থেকে হাজার হাজার খেলোয়াড় ‘আবা দিয়া ঘঁটি ধররে হেইও…বলে ঘুঁটিতে ঝাপিয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত খেলার স্থান থেকে এক কিলোমিটার দূর বালিয়ান গ্রামে কচুরিপানা ভর্তি একটি পুকুরে ঘুঁটি খেলাটি চলছি। এসময় দেখা যায় ট্রাকে করে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে শত শত খেলোয়াড়রা খেলতে আসছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতে চারদিক থেকে টর্চ লাইট ও মোবাইলে লাইটে আলোয় খেলার চারপাশ অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। ঘুঁটি খেলাটি মূলত পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ চার ভাগে বিভক্ত হয়ে খেলোয়াড়রা খেলে। খেলায় কোন রেফারী নেই,নিদ্দিষ্ট কোন সময় ও খেলোয়াড়ের সংখ্যা নেই।
পৌষ মাসের শেষ দিনকে ফুলবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় পহুরা। পুহুরা উপলক্ষে তেলিগ্রাম বড়ই আটা পরগনা ও তালুক সীমন্তে বসে গ্রামীণ মেলা। বিকেল বেলায় ঘুঁটি খেলা ও গ্রামীণ মেলাকে ঘিরে বড়ই আটা গ্রামটি পরিণত হয় গ্রামের নারী পুরুষদের আরেকটি মিলন মেলার স্থল। ঘুঁটি খেলা ও পহুরা উপলক্ষে বড়ইহাটা, দেওখোলা, লক্ষিপুর, তেলিগ্রাম,ভাটিপাড়া, বালাশ্বর, শুভরিয়া, কালিবাজাইল, দশমাইল, কুকরাইল, কাটাখালি, মোহাম্মদনগরসহ আশপাশের গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আগের দিন চলে আসে আত্মীয় স্বজনরা। গ্রামে গ্রামে গরু, খাসি জবাই হয়। প্রায় প্রতিটি ঘরে তৈরি করা হয় শীতের গোটা পিঠা, মরিচ পিঠা, কলার পিঠা, দুধ পিঠা, মুড়ি ও চিড়ার মোয়া।এছাড়াও ঘরে ঘরে রান্না হয় গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহি খাবার।
মুক্তাগাছা জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী ও বৈলরের জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের ‘পরগনা’ আর ‘তালুক’ জমির পরিমাপ বিরোধ মিমাংসাকল্পে শক্তি ও কৌশলের ‘ঘুঁটি’ খেলার আয়োজন করেছিলেন। ঘুঁটি খেলায় মুক্তগাছা জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী প্রজারা বিজয়ী হয়েছিল। সেই থেকে জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী‘পরগনা’ এলাকার জমির পরিমাপ সাড়ে ৬ শতাংশে এক কাঠা ও জমিদার হেম চন্দ্র রায়ের ‘তালুক’ এলাকায় জমির পরিমাপ ১০ শতাংশে এক কাঠা।
বড়ই আটা গ্রামে আবুল হোসেন (৮২) বলেন, ঘুঁটি খেলার দুই দিন আগে থেকে গ্রামে আনন্দ উৎসব চলে। প্রতি বছরই খেলায় খেলোয়াড় ও দর্শনার্থী বেশি হচ্ছে। বাপ-দাদারা খেলেছে, আমরা খেলেছি এখন আমাদের সন্তান ও নাতীপুতিরা খেলছে। হাজার হাজার মানুষ খেলাটি খেলে তারপরও কোন সময় ঝগড়া বিবাদ হয়না।
হুম ঘুঁটি স্মৃতি সংসদের সভাপতি নাট্যকার আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন,দুই জমিদারে জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ মিমাংসা হয়েছিল ঘুঁটি খেলার মাধ্যমে। ঘুঁটি খেলা আমাদের ঐতিহ্য, জমিদার আমল থেকেই চলছে খেলাটি। আমার পূর্ব পুরুষরা খেলাটির আয়োজন করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন আমরা আয়োজন করে থাকি। এবছর ২৬৪ তম খেলাটি হবে।
মন্তব্য